বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
History

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পটভূমি-০১

Pathokia 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যে ভাবে শুরু

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনের  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ  অধ্যায়। রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতার ইতিহাস আমদের সবার জানা উচিত। আমাদের আগামী প্রজন্ম যেন স্বাধীনতা সম্পর্কে  অবহিত থাকে সেই ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে তারা জানতে পারে কিভাবে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে, কতো রক্ত ঝড়াতে হয়েছে, কতো জীবন দিতে হয়েছে। এতে তাদের দেশের প্রতি মমত্ববোধ , ভালোবাসা এবং দেশপ্রেম গড়ে উঠবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ

ভাষা আন্দোলন (The language Movement) সংক্ষেপে আলোচনাঃ

  • ১৯০১ সালে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী রংপুরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত দেওয়ার আহবান জানান।
  • পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা । পক্ষান্তরে সমগ্ৰ পাকিস্তানে উর্দু ভাষাভাষীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৬ ভাগ ।
  • ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় জনাব তাসাদ্দুক হোসেন সভাপতিত্বে পূর্বপাকিস্তান যুবকর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।এ সম্মেলনেই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের অফিস ও আইন আদালতের ভাষা এবং শিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলাকে চালু করার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্ৰহণ করা হয়।
  • ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ( তমদ্দুন মজলিশ ) – ( Tamuddun Majlis ) নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে চালু করার দাবি নিয়ে এগিয়ে আসে ( তমদ্দুন মজলিশ ) । তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ( পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ) প্রকাশ করে । এ পুস্তিকার লেখক ছিলেন তিনজন- অধ্যাপক আবুল কাসেম, ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন এবং আবুল মনসুর আহমদ।
  • ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় ( রাষ্ট্রভাষা সংগ্ৰাম পরিষদ ) ( State Language Movement Association ) গঠিত হয়।
  • ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান প্রথম গণপরিষদ অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু ভাষাতে অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হলে পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষারূপে সরকারী স্বীকৃতির দাবি জানান।কিন্তু গণপরিষদ এ দাবি প্রত্যাখ্যান করলে পূর্ব বাংলার ছাত্র শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী মহলে অসন্তোষ দেখা দেয়।
  • ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ কামরুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে ( সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ) ( All Parties State Language Movement Association ) গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে সরকারের ষড়যন্ত্র রোধ করার জন্য ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়।ঐ দিন ঢাকায় বহুছাত্র আহত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকে গ্ৰেফতার হন।একজন্য ১৯৪৮ – ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময়কালে প্রতি বছর ১১ মার্চ ( ভাষা দিবস ) ( Language day) হিসেবে পালন করা হত।
  • ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন ( উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ) ২৪ মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা বার বার বললে উপস্থিত ছাত্ররা ( না না ) বলে তীব্র প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে ।
  • ১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে ইসলামী আদর্শের খাতিরে বাংলা ভাষার জন্য ( আরবি হরফ ) বা প্রকান্তরে ( উর্দু হরফ ) গ্ৰহণের প্রস্তাব করা হয়।
  • ১৯৪৯ সালে পূর্ব বাংলা সরকার বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে ( পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি ) গঠন করে। মওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন এ কমিটির সভাপতি।
  • ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঘোষণা করেন ( উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে )।
  • ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এক জনসভায় ঘোষণা করেন ( উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা )।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন সংক্ষেপে আলোচনাঃ

  • পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ঐ দিনই আর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে ( সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ) ( All Parties State Language Movement Committee ) গঠন করা হয়।
  • ( সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ) ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রোজ বৃহস্পতিবার ( রাষ্ট্রভাষা দিবস ) পালনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সারাদেশে হরতাল কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করে। ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে ভীত হয়ে নুরুল আমিন সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সসংগঠিভাবে ৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ( রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ) শ্লোগান দিতে দিতে বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে সমবেত হয়। পুলিশ উপস্থিত ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করলে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ এক পর্যায়ে গুলি বর্ষণ করলে সালাম,বরকত,রফিক,জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন।
  • পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিশাল শোভা যাত্রা বাহির হয়। এ শোভাযাত্রাযর উপরও পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ফলে শফিউর রহমান মৃত্যুবরণ করেন।
  • ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন এবং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমিন।
  • ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন মালিক মোহাম্মদ ফিরোজ খান নুন।
  • ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করা হয়।
  • ভাষা শহীদ আবুল বরকত ১৯২৭ সালে মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ভাষার জন্য আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়

১৯৫৪ সালের নির্বাচন ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক নির্বাচন ও যুক্তফ্রন্ট নিয়ে আলোচনা(The Provincial Election of 1954 and United Front)

নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগকে চরম শিক্ষা দেওয়ার জন্য ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সমমনা কয়েকটি বিরোধীদল ( যুক্তফ্রন্ট ) নামে একটি ঐক্যজোট গঠন করে। যক্তফ্রন্ট মূলত ৪টি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত। এগুলো হলো –

  • মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়।
  • এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টি গঠিত হয়।
  • মওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বাধীন নেজাম-ই-ইসলামী গঠিত হয়।
  • হাজী দানশের নেতৃত্বাধীন বামপন্থী গণতন্ত্রী দল গঠিত হয়।

নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল নৌকা এবং ২১ দফা দাবীর প্রথম দাবী ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করা। ১৯৫৪ সালের ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মধ্য ২২৩ আসনে জয়লাভ করে। ১৯৫৪ সালে ৪ এপ্রিল প্রাদেশিক নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলায় মন্ত্রিসভা গঠন করে। মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী হন এ.কে. ফজলুল হক। উল্লেখ্য, শেখ মুজিবুর রহমান এই মন্ত্রিসভায় কৃষি, সমবায়, পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালের ৩০ মে ফজলুল মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব বাংলায় কেন্দ্রের শাসন জারি করেন।

চলমান ২য় অংশঃ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পটভূমি-০২

Recommended Posts

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মসজিদ
World Heritage Bangladesh

ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মসজিদ

মুসলমানদের তথা মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র উপসনালয় মসজিদ। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ হলেও এখানকার ইসলামের ইতিহাস তেমন পুরাতন নয়। বাংলাদেশে কিছু প্রাচীন মসজিদ ছাড়া মোঘল আমলের পূর্বের প্রায় সকল প্রাচীন মসজিদ ই ধ্বংস হয়ে গেছে। আজ আমরা তেমনই কিছু ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মসজিদ সম্পর্কে জানবো। সিংগাইর মসজিদঃ মধ্যযুগীয় এই সিংগাইর মসজিদটি ষাটগম্বুজ মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে অবসিহত। […]

Pathokia 

গেঁটেবাত থেকে মুক্তির উপায়

গেঁটেবাত থেকে মুক্তির উপায় শতাধিক প্রকারের বাতরোগের মধ্যে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা গেঁটেবাত অন্যতম। সাধারণত বয়স্করা এ রোগে আক্রান্ত হয়।কম বয়সী ছেলেমেয়েদের বেলায় গিঁটে ব্যথা বা যন্ত্রনা হওয়া রিউমেটিক ফিভার বা বাতজ্বর ( Rheumatic Fever ) জাতীয় অন্য রোগের লক্ষণ হতে পারে। মানব শরীরে রক্তের সঙ্গে ইউরিক অ্যাসিড (Uric Acid) নামে এক ধরনের উপাদান থাকে, যার […]

Pathokia 
Artimis:NASA’s Mega Moon Rocket
Science and Technology

আর্টেমিস : আবারও চাঁদের বুকে মানুষ

আর্টেমিস :আবারও চাঁদের বুকে মানুষ Artimis:NASA’s Mega Moon Rocket দীর্ঘ পাঁচ দশক পর আবারও চাঁদের বুকে মানুষ পাঠানোর অভিযানে নাসা। তিন ধাপের মিশনে মনুষ্যবিহীন প্রথম রকেট টি ২৯ আগস্ট যাওয়ার কথা ছিল। আর শেষ ধাপে পাঠানোর কথা ছিল মানুষ। এর মাধ্যমে শুরু হতে যাচ্ছিল বহুল প্রতীক্ষিত আর্টেমিস যুগের। ফ্লোরিডার কেপ কেনেডি স্পেস সেন্টারে (Kennedy Space […]

Pathokia