World Heritage Bangladesh

ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মসজিদ ষাট গম্বুজ

Pathokia 

মুসলমানদের তথা মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র উপসনালয় মসজিদ। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ হলেও এখানকার ইসলামের ইতিহাস তেমন পুরাতন নয়। বাংলাদেশে কিছু প্রাচীন মসজিদ ছাড়া মোঘল আমলের পূর্বের প্রায় সকল প্রাচীন মসজিদই ধ্বংস হয়ে গেছে। আজ আমরা তেমনই কিছু ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মসজিদ সম্পর্কে জানবো।

ষাট গম্বুজ মসজিদঃ

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ গুলোর তালিকায় ষাট গম্বুজ মসজিদটি র অবস্থান প্রথম দিকে। ষাট গম্বুজ মসজিদটি এশিয়া মহাদেশের অন্তর্ভূক্ত বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিনে খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায় সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে  অবস্থিত বাংলার এই প্রাচীনতম স্থাপনা । বাগেরহাট জেলায় আরো বেশ কিছু প্রাচীন স্থাপনা যেমন মসজিদ, সমাধি ও বড় বড় দিঘীর সন্ধান পাওয়া গেছে । এটি  বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী তিনটি স্থাপনা গুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা । স্বাধীন সুলতানি আমলের এই ঐতিহাসিক নিদর্শন ঐতিহ্য সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে বাংলার এই প্রাচীনতম স্থাপনা ১৫ শতকে সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৩৫-৫৯) এর শাসনামলে এই অঞ্চলের প্রশাসক খান আল আজম উলগ জাহান আলী কর্তৃক খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তোলে এবং প্রশাসনিক কাজ চালাবার জন্য একটি দরবারহল নির্মান করেন, যা পরবর্তীতে ষাট গম্বুজ মসজিদ রুপে পরিচিত হয়। এর নির্মাণশৈলীতে তুঘলকি ও জৌনপুরী  স্থাপত্য সুস্পষ্ট।

এই প্রাচীন স্থাপনায় কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তাই এটি কোন সময় নির্মিত হয়েছিলো সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ষাট গম্বুজ মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখে অনুমান করা যায় এটি  খান-জাহান (রঃ) এর আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে ধারনা করা যায়।মুসলিম জাতিসত্তার বিকাশ ধারা, বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ ধারা এবং বাংলাদেশে জাতিসত্তার বিকাশ ধারায় যে সকল মুসলিম মনীষীর অবদান অনস্বীকার্য তার মধ্যে হলেন খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলার অন্তর্গত হযরত আলী রহমাতুল্লাহ আলাইহে।

নির্মাণ শৈলীঃ

এই মসজিদটি বাগেরহাট শহরের তিন মাইল পশ্চিমে ঘোড়া দিঘীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। প্রাচীন কালে মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশের জন্য দু’টি প্রবেশ পথ ছিল। একটি পূর্ব দিকে এবং অপরটি  উত্তরে। পূর্ব দিকের প্রবেশপথটি বর্তমানে থাকলেও উত্তরের প্রবেশ পথটি বর্তমানে বিলুপ্ত। একতলা বিশিষ্ট আয়তাকার এই মসজিদটি মূলতঃ মাটি পোড়ানো ইটের তৈরি।  পোড়ামাটির ফলক দ্বারা এই মসজিদের অলংকরন এর কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।

মসজিদটির পূর্ব দেয়ালে ১১টি খিলানযুক্ত বৃহৎ আকারের দরজা আছে কিন্তু মাঝের দরজাটি আকারে বড় এবং  উত্তর ও দক্ষিনে ৭টি করে দরজা রয়েছে। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে ১০টি মেহরাব। মাঝের মেহরাবটি আকারে বড় এবং কারুকার্য মন্ডিত। এর উত্তরে চারটি এবং দক্ষিণে পাঁচটি মেহরাব রয়েছে। মূল মেহবারটির পাশাপাশি উত্তরে একটি ছোট দরজার রয়েছে। ধারণা করা হয় খানজাহান আলীর দরবারের কাজের প্রয়োজনে এই দরজাটি ব্যবহার করতেন। নামাজ আদায়ের পাশাপাশি মসজিদটি তখন প্রশাসনিক প্রয়োজনে দরবার কক্ষ এবং শিক্ষার প্রয়োজনে মাদ্রাসা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মসজিদের চার কোনে চারটি মিনার রয়েছে। এগুলোর গোলাকার  নকশা  যুক্ত এবং  উপরের দিকে ক্রমশঃ সরু। এদের কার্ণিশের বলয়াকার ব্যান্ড এবং চূঁড়ায় গোলাকার গম্বুজ আছে। মিনারগুলোর উচ্চতা, কার্নিশের চেয়ে বেশি।  সামনের দুটি মিনারে  নিচ থেকে ২৬টি ধাপে প্যাচানো সিঁড়ি রয়েছে যার একটির নাম রওশন কোঠা, এবং অন্যটির নামআন্ধার কোঠা।  এই  মিনার গুলো থেকে আজান দেওয়ার ব্যবস্থা  ছিল । মসজিদের অভ্যন্তরে মোট ৬০টি পিলার বা স্তম্ভ আছে। এগুলো উত্তর-দক্ষিণে ৬ সারিতে আছে এবং প্রত্যেক সারিতে আবার ১০টি করে স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভই পাথর কেটে , তৈরী শুধু ৫টি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। এই ষাটটি স্তম্ভ ও এর চারপাশের দেয়ালের ওপর গম্বুজ তৈরি করা হয়েছে ।  মসজিদের ছাদে মোট ১১টি সারিতে ৭৭টি গম্বুজ রয়েছে। মোট  সাতটি স্তম্ভ পুরো মসজিদের গম্বুজ সমূহের ভারবাহী ছাদকে ধারণ করে আছে।

উপর থেকে দৃশ্যমান ষাট গম্বুজ মসজিদ

ষাট গম্বুজ মসজিদটি বাইরের দিকে (উত্তর-দক্ষিণ) ১৬০ ফুট এবং ভিতরের দিকে ১৪৩ ফুট লম্বা।  পূর্ব-পশ্চিমে (বাইরের দিক) ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। ইট নির্মিত দেয়ালগুলো ৮·৫ ফুট পুরু। শোনা যায়, নির্মান কাজে ব্যবহৃত পাথর সমুহ ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল মতান্তরে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম তেকে তাঁর  (খান জাহান (রঃ) )অলৌকিক ক্ষমতা বলে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন।

ষাট গম্বুজ মসজিদের ভিতরের দৃশ্য

বাংলার প্রাক মোঘল আমলের এই মসজিদটির  নাম  কেনো ষাট গম্বুজ মসজিদ হলো তা প্রকৃতই গবেষণার বিষয়। মসজিদের মোট গম্বুজের সংখ্যা ৭৭ টি।  চার মিনারের চারটি গম্বুজসহ গম্বুজের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৮১টি। তবে কেন এর নাম ষাট গম্বুজ মসজিদ হল তা নিয়ে রয়েছে দুটি মত। একটি মতানুসারে মসজিদটি ৭টি গম্বুজের সারি থেকে এ মসজিদটি সাত গম্বুজ মসজিদ হিসেবে ডাকা হতো। কালক্রমে এই মসজিদটি সাত গম্বুজ মসজিদ হতে ষাটগম্বুজ মসজিদে পরিণত হয়।অপর মতানুসারে ৭টি স্তম্ভ বা খাম্বাজ বিশিষ্ট মসজিদটি সাত খাম্বাজ মসজিদ হিসাবে পরিচিত ছিল পরবর্তিতে তা পরিবর্তিত হয়ে ষাটগম্বুজ মসজিদে পরিনত হয়। তুঘলক-জৌনপুরী  নির্মাণশৈলীর সাথে সাথে বাংলার স্থানীয় রীতির সংমিশ্রণে নির্মিত  এই মসজিদটিতে বর্তমানে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য লোক বাগেরহাট জেলায় ভ্রমণে আসে। শুধু দেশেই নয় বরং বাংলাদেশর বাহির থেকেও পর্যটকরা ষাট গম্বুজ মসজিদ পরিদর্শন করতে।

বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগ পুরাকীর্তি হিসেবে এই ঐতিহাসিক মসজিদ এবং খানজাহান (রঃ) এর মাজার শরীফের সংরক্ষণের জন্য  দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন ।ষাট গম্বুজ মসজিদ চত্ত্বরে একটি  জাদুঘর রয়েছে ।

প্রাচীন মসজিদ সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুণ…

Recommended Posts

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মসজিদ
World Heritage Bangladesh

ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মসজিদ

মুসলমানদের তথা মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র উপসনালয় মসজিদ। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ হলেও এখানকার ইসলামের ইতিহাস তেমন পুরাতন নয়। বাংলাদেশে কিছু প্রাচীন মসজিদ ছাড়া মোঘল আমলের পূর্বের প্রায় সকল প্রাচীন মসজিদ ই ধ্বংস হয়ে গেছে। আজ আমরা তেমনই কিছু ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মসজিদ সম্পর্কে জানবো। সিংগাইর মসজিদঃ মধ্যযুগীয় এই সিংগাইর মসজিদটি ষাটগম্বুজ মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে অবসিহত। […]

Pathokia 

গেঁটেবাত থেকে মুক্তির উপায়

গেঁটেবাত থেকে মুক্তির উপায় শতাধিক প্রকারের বাতরোগের মধ্যে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা গেঁটেবাত অন্যতম। সাধারণত বয়স্করা এ রোগে আক্রান্ত হয়।কম বয়সী ছেলেমেয়েদের বেলায় গিঁটে ব্যথা বা যন্ত্রনা হওয়া রিউমেটিক ফিভার বা বাতজ্বর ( Rheumatic Fever ) জাতীয় অন্য রোগের লক্ষণ হতে পারে। মানব শরীরে রক্তের সঙ্গে ইউরিক অ্যাসিড (Uric Acid) নামে এক ধরনের উপাদান থাকে, যার […]

Pathokia 
Artimis:NASA’s Mega Moon Rocket
Science and Technology

আর্টেমিস : আবারও চাঁদের বুকে মানুষ

আর্টেমিস :আবারও চাঁদের বুকে মানুষ Artimis:NASA’s Mega Moon Rocket দীর্ঘ পাঁচ দশক পর আবারও চাঁদের বুকে মানুষ পাঠানোর অভিযানে নাসা। তিন ধাপের মিশনে মনুষ্যবিহীন প্রথম রকেট টি ২৯ আগস্ট যাওয়ার কথা ছিল। আর শেষ ধাপে পাঠানোর কথা ছিল মানুষ। এর মাধ্যমে শুরু হতে যাচ্ছিল বহুল প্রতীক্ষিত আর্টেমিস যুগের। ফ্লোরিডার কেপ কেনেডি স্পেস সেন্টারে (Kennedy Space […]

Pathokia