সম্রাট শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সিংহাসন

সম্রাট শাহজাহানের ‘ময়ূর সিংহাসন’
সম্রাট শাহজাহানেরময়ূর সিংহাসনপৃথিবীর সবচেয়ে দামী সিংহাসন

সম্রাট শাহজাহান সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যকে এক অনন্য অবস্থানে নিয়ে গেলেও ইতিহাস তাকে বিখ্যাত সব স্থাপত্য ও কীর্তির জন্য মনে রাখবে। স্ত্রীর মৃত্যু শোকে তার সমাধির উপর বিখ্যাত তাজমহল নির্মাণ করে যেমন নিজেকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রেখেছেন তেমনি আগ্রার দুর্গ কিংবা দিল্লীর সুবিশাল জামে মসজিদ এর মাধ্যমেও নিজেকে আলাদা ভাবে পরিচিত করতে সক্ষম হয়েছেন। বলা হয়ে থাকে তার সময়ে মুঘল স্থাপত্যবিদ্যা সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি লাভ করে এবং তিনি ছিলেন এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তবে তার একটি মহাকীর্তি নিয়ে তুলনামূলক কম আলোচনা হয় ময়ূর সিংহাসন।

সম্রাট শাহজাহানের ‘ময়ূর সিংহাসন’

 

তাজমহল কিংবা শাহজাহানের নির্মিত অন্যান্য কীর্তির তুলনায় এর গুরুত্ব কিংবা মূল্য কোন অংশেই কম নয় । মুঘল আমলে শিল্প সাহিত্যে ময়ূরের এক অনন্য স্থান ছিল যা অন্য কোন প্রাণীর ছিল না। মুঘল আমলে অঙ্কিত চিত্রকর্মগুলোতে ময়ূরের অবয়বর ফুটিয়ে তোলা হতো সুনিপুণভাবে। সিংহাসনে কি পরিমাণ স্বর্ণ ও হীরে জহরত ব্যবহার করা হয়েছিল সেটি শুনলে আপনার চোখ কপালে উঠবে। আনুমানিক ১১৫০ কেজি স্বর্ণ ও প্রায় ২৩০ কেজি বিভিন্ন মূল্যবান পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল এই রাজকীয় সিংহাসন তৈরিতে। রুবী ও বিখ্যাত কোহিনুর হীরার মতো দুর্লভ জিনিস ব্যবহার করা হয় এতে। ধারণা করা হয় বিভিন্ন যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে যেসব দামি ও দুর্লভ অলংকার মুঘল রাজকোষে জমা হয়েছিল সেগুলো দিয়েই এই সিংহাসনের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। তাজমহল নির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী আনা হয়েছিল এদিক থেকে ময়ূর সিংহাসন ছিল ব্যতিক্রম। ১১৬টি পান্না ১০৮টি রুবী ও আরো অসংখ্য মূল্যবান পাথর ব্যবহার করা হয়। যেগুলোর অনেকগুলো ছিল অত্যন্ত দুর্লভ। সিংহাসন এর পেছনে যে দুটো ময়ূর ছিল সেগুলোর লেজ ছিল ছড়ানো, যেটি সিংহাসনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। কথিত আছে সম্রাট শাহজাহান নবী হযরত সুলাইমান আলাই সাল্লাম কে অনুসরণের চেষ্টা করতেন। সুলাইমান আলাইহিস সালামের সুবিশাল সাম্রাজ্যের পাশাপাশি একটি রাজকীয় সিংহাসন ছিল যেটি মুঘল সম্রাট শাহজাহানকে বেশ প্রভাবিত করে। এজন্য তিনি নিজেও বিশাল সাম্রাজ্যের পাশাপাশি একটি রাজকীয় সিংহাসনে বসে সাম্রাজ্য পরিচালনার স্বপ্ন দেখতেন।  ১৬২৮ সালে যেদিন সম্রাট শাহজাহান সম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন সেদিনই প্রথম সেই রাজকীয় সিংহাসন প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়। বাছাই করা স্বর্ণকার ও জহুরীদের মাধ্যমে প্রায় সাত বছর ধরে এই সিংহাসন তৈরি করে নেয়া হয়েছিল। জিন-ব্যাপটিস্ট   ট্যাভেরিয়ার নামের একজন ফরাসি অলংকারীকে আমন্ত্রণ জানান সম্রাট শাহজাহানের পুত্র সম্রাট আওরঙ্গজেব। ১৬৬৫ সালে তিনি ভারতবর্ষে আসেন এবং রাজপ্রাসাদ প্রবেশ করে ময়ূর সিংহাসন প্রত্যক্ষ করার পর তার চোখ কপালে উঠে যায়। তার ভাষ্যে সিংহাসনটি ছিল বিশাল আকৃতির এতে চারটি পায়া ছিল, যেগুলো ছিল খাটি সোনার তৈরি। সিংহাসনের উপরের ছাউনি ধরে রাখতে যে বারোটি খুঁটি ছিল সেগুলো ছিল সবচেয়ে মূল্যবান, কারন সেইগুলোতে বিভিন্ন দুর্লভ পাথর ও হীরা ব্যবহার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে পারস্যের সম্রাট নাদির শাহের সন্ধির ফলে অত্যন্ত দামী ও ঐতিহ্যবাহী ময়ূর সিংহাসন হাতছাড়া হয়ে যায়। নাদির শাহ্ কয়েক বছর পর নিহত হন এবং রাজপ্রাসাদের লুটের ঘটনা ঘটে। অনেকে বলে থাকেন লুটেরা ময়ূর সিংহাসন ভেঙে ভাঙ্গা টুকরোগুলো চড়া দামে বিক্রি করে। মুঘল সাম্রাজ্যের অনুকরণে পরবর্তীতে ইরানেও ময়ূর সিংহাসন তৈরি করা হয়। যেটি এখন তেহরান জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। বৃটেনের একটি জাদুঘরে ময়ূর সিংহাসনের একটি পায়া সংরক্ষিত আছে। ময়ূর সিংহাসন ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের জৌলুস তুলে ধরা এক কালজয়ী কীর্তি। ময়ূর সিংহাসন যতই লুটেরাদের হাতে ক্ষতবিক্ষত হোক যতই বিদেশী শক্তির হাতে অর্পিত হোক না কেন এই অনিন্দ্যসুন্দর কীর্তির জন্য ইতিহাস সবসময় সম্রাট শাহজাহানকেই স্মরণ করবে।

ইতিহাস বিষয়ে জানতে এখানে ক্লিক্ করুন….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *