
বাংলাদেশে রোবোটিক্স কতটা এগিয়ে এবং অর্জন কতখানি?
বাংলাদেশে রোবোটিক্স কতটা এগিয়ে এবং অর্জন কতখানি?
রোবোটিক্স শব্দটি এসেছে ( রোবোট ) শব্দ হতে যা পরে হয় চেক লেখক ও নাট্যকার কারেল কাপেক ( Karel Capek ) এর একটি নাটক হতে যেটি ১৯২০ সালে প্রকাশ পেয়েছিল। রোবোটিক্স এর মূল বিষয়টিই হলো রোবোটকে ঘিরে। রোবোট হলো কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বা যন্ত্রমানব যা মানুষের অনেক দুঃসাধ্য ও কঠিন কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে পারে। এর কাজের ধরন দেখে মনে হবে এর ভেতর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রয়েছে।
Robot শব্দটি মূলত এসেছে স্লাভিক শব্দ Robot হতে যার অর্থ হলো ( শ্রমিক)। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি অনুযায়ী ( রোবোটিক্স ) শব্দটির প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯৪১ সালে প্রকাশিত ( আইজকা অসিমভ) এর ছোট সায়েন্স ফিকশন গল্প ( লায়ার) এ। মজার ব্যাপার হচ্ছে আইজাক অসিমভ তার গল্পে কাল্পনিক রোবোটের জন্য যে তিনটি সুত্র বা নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল, তথা রোবোট কখনো মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে না, ১ম নিয়ম ভঙ্গ না করে রোবোট মানুষের সকল নির্দেশ পালন করবে এবং ১ ও ২ নং নিয়ম ভঙ্গ না করে রোবোট নিজেদের রক্ষা করবে; আধুনিক রোবোটের জন্য এই ৩টি মূল সূত্রই ব্যবহার করে উন্নত মানের রোবট বানানো সম্ভব হয়।
পৃথিবীর প্রথম রোবটঃ
প্রথম সত্যিকার রোবোটটি তৈরি করেন আমেরিকান উদ্ভাবক জর্জ চার্লস ডেভল ( George Charles Devol )। ১৯৫০ সালে তার তৈরি প্রথম ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবোটের নাম ছিল ইউনিমেট। কিন্তু এই রোবোট তৈরির প্রজেক্টের উদ্যেক্তা ছিলেন আরেক আমেরিকান জোসেফ ফ্রেডরিক এন্জ্ঞেলবার্গ ( Joseph Frederick Engelberge )। রোবোট তৈরির টেকনিক্যাল বিষয়ে তাঁর অবদান না থাকলেও এবং তৈরিকৃত ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবোটটির পেটেন্ট চার্লস ডেভল এর নামে থাকলেও উদ্যেক্তা হিসেবে সম্মান প্রদর্শনে এন্জ্ঞেলবার্গকেই রোবোটিক্সের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে।
রোবট কিঃ
রোবোট মানেই যে মানুষের মত যন্ত্র হতে হবে তা নয়। রোবোট এমন একটি যন্ত্র যা কখনো সম্পূর্ণরূপে বা অংশত মানুষকে নকল করবে; কখনো চেহারায়, কখনো কাজের মধ্য দিয়ে, কখনো আবার দুভাবেই। অবশ্য এতে এমনভাবে প্রোগ্ৰাম বেঁধে দেয়া আছে যা প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন করে বেঁধে দেয়া যায়। সাধারণভাবে কোনো যন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারলেই যে তাকে রোবট বলা হবে এমন কিন্তু নয়। যেমন একটি দরজায় যদি সেন্সর এবং ক্যামেরা লাগানো থাকে এবং ঐ সেন্সর কোনো কিছুর উপস্থিতির টের পাবার পর ক্যামেরার ছবি দ্বারা তাকে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজাটি খুলে যাবে; এমন কোনো সিস্টেমকে রোবোট বলা যাবে না। একটি বড়জোর Intelligent System হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। একটি যান্ত্রিক সিস্টেম তখনই রোবট হয়ে উঠবে যখন এতে মোবিলিটি ( Mobility ), মোশন ( Motion ), সেন্সিং ( Sensing ) এবং ইন্টেলিজেন্স ( Intelligence ) এর সমন্বয় ঘটবে। যেমন চালকবিহীন কোনো যান যদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার গতিপথের যে কোনো বাধা এড়িয়ে নিরাপদে স্থানান্তরিত হতে এবং তার জন্য নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে তবে সেটিকে একটি রোবট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে।
রোবটের ব্যবহারঃ
রোবট স্বয়ংক্রিয় ( Automatic ), আধা স্বয়ংক্তিয় ( Semi-Automatic ) বা রি- প্রোগ্ৰামেবল তথা মানুষ নিয়ন্ত্রিত এই তিন ধরনের হতে পারে। আজকের দিনে রোবোটিক্স হলো দ্রুত বর্ধনশীল একটি ক্ষেত্রে। প্রযুক্তিগত অগ্ৰগতির সাথে সাথে গবেষণা, নকশা এবং নতুন নতুন রোবোট তৈরির ফলে বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে- তা সে ঘরোয়া, বাণিজ্যিক বা সামরিক কাজই হোক না কেন সব কাজেই রোবোট কে ব্যবহার করা হয়। কিছু কিছু রোবোট শুধু প্রোগ্ৰাম অনুসারেই কাজ করে আবার অনেকগুলোকে দূর থেকে লেজার রশ্নি বা রেডিও সিগন্যালের সাহায্যে নিয়ন্ত্রন করা যায়। যানবাহন ও গাড়ির কারখানায়, বিপজ্জনক যেমন- বিস্ফোরক নিস্ক্রিয়করণ কাজে, শিল্পক্ষেত্রে কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তার কাজে, ঘরের প্রাত্যহিক অনেক কাজকর্ম এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে জটিল সব অপারেশনে সার্জনদের নানা ধরনের কাজে রোবোট সহায়তা করে।
রোবোটিক্স-এ বাংলাদেশ এর অর্জনঃ
রোবোটিক্স এর ভূবনে বাংলাদেশের পদচারণা সাম্প্রতিককালে হলেও ইতোমধ্যে দেশের জন্য তরুণ প্রজন্ম বিপুল সম্মান বয়ে এনেছে। ২০১০ সাল থেকে নাসার এক্সপ্লোরেশন সিস্টেম এর উদ্যগে লুনার এক্সপ্লোরেশন নামে এক বার্ষিক প্রতিযোগিতা শুরু হয় যার নাম দেয়া হয় ( লুনাবোটিক্স মাইনিং কম্পিটিশন )। দ্বিতীয় বছরের আয়োজনেই অর্থাৎ ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয় একটি টিম – ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ( চন্দ্রবোট )। বাংলাদেশেই যে নাসার নির্ণায়ক অনুযায়ী একটি রোবোট তৈরি করা সম্ভব সেটি আয়োজকদের বুঝিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়াটাই ছিল মূল চ্যালেঞ্জ।
সে চ্যালেঞ্জ ভালোভাবে উতরে যাবার পর এর পরের বছর ২০১২ সালে তৃতীয় বার্ষিক লুনাবোটিক্স কম্পিটিশন বাংলাদেশ থেকে তিনটি টিম অংশ নেয় – ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ( চন্দ্রবোট ২ ); আইইডিটি থেকে ( লুনাটিয়ান ) এবং এমআইএসেটি থেকে ( রোবোমিস্ট )। সে বার মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় বিশ্বের ৮ টি দেশ থেকে আসা ৫৫ টি দল। নাসার নিয়মানুযায়ী মাত্র ১৩ টি দল উত্তীর্ণ হতে পারে, যার মধ্যে এশিয়ার মধ্যে সেরা এবং সবগুলো দলের মধ্যে ( চন্দ্রবোট-২ ) ১২তম রেঙ্গ নিয়ে দেশে ফেরত আসে। ২০১৩ সালে চতুর্থ বার্ষিক লুনাবোটিক্স কম্পিটিশনে বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয় ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ( ব্র্যাক, আইইউটি, এমনআইএসটি এবং প্রথমবারের মতো বুয়েট, কুয়েট ও এনএসইউ ) পৃথক দল।
এর চূড়ান্ত পর্বে এমআইএসটি ( মিলিমিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ) ৩টি ক্যাটাগরিতে যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করে। অন্য আরেকটি ক্যাটাগরিতে বুয়েট দল তিনটি স্থান অর্জন করে। ২০১৫ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল রোবোটিক্স চ্যালেণ্জ্ঞ ২০১৫ এর মূল পর্বে বাংলাদেশ-এর তিনটি দল BUET Exponential, RoboSUST এবং DUET TimeOut অংশগ্ৰহণ করে যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থান অর্জন করে প্রযুক্তিবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। প্রতিযোগিতায় আয়োজক ভারতসহ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, ফ্রান্স, ফিলিপাইন, নেপাল, সাউথ আফ্রিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্ৰহণ করে।
বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক কোনো রোবোটিক্স কম্পিটিশনে একসাথে একাধিক টিমের নজরকাড়া সাফল্যের ঘটনা এই ছিল প্রথম। বাংলাদেশের এ সাফল্য প্রমাণ করে ফ্রান্স, ফিলিপাইন, ভারতসহ রোবোটিক্স শিল্পে উন্নত দেশগুলোর মতো সুযোগ সুবিধা না থাকলেও রোবোটিক্স বাংলাদেশে অনেক দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। উপযুক্ত পৃষ্ঠপকতা, অর্থায়ন, উন্নত ল্যাব এবং টেকনিক্যাল সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে পারলে বাংলাদেশও রোবোটিক্স শিল্পে অভাবনীয় অর্জন সাধন করতে পারবে।
Science & Technology সম্পর্কে আরো জানতে এখানে ক্লিক করুণ…