মাথাব্যথা নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সতর্কতাঃ
কেস স্টাডিঃ
একজন রোগীর স্ট্রোক হয়েছিল অর্থাৎ ব্রেইনে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। তার মাথায় এক ধরনের ব্যথা হয় কিন্তু তিনি জানতেন না এই মাথাব্যথা ব্রেইন স্ট্রোকের লক্ষণ। মাথাব্যাথাটা আস্তে আস্তে কমে তাই তিনি আর হাসপাতালে আসেননি এবং ডাক্তারের সাথে আলোচনা করেননি। কিন্তু কয়েকদিন পরে তার খিঁচুনি শুরু হয় এপর্যায়ে পরিবার তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে তখন কিছু পরীক্ষা করে দেখা যায় তার ব্রেইনে রক্তক্ষরণ হয়েছে অর্থাৎ স্ট্রোক হয়েছে। রোগীকে সব ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয় কিন্তু তিনি না ফেরার দেশে চলে যান । তবে তিনি যদি আগেই হাসপাতালে আসতেন, প্রথম যখন মাথা ব্যথা হয়েছিল তাহলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকত।…
আজকে আমরা আলোচনা করবো, ওই মাথাব্যথাটা কি ধরনের হলে সংকার কারণ হবে, যাতে আপনার প্রিয়জনের বা আশেপাশের কারো যদি এই ধরনের মাথাব্যথা দেখা দেয় তখন সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেন সময়মতো হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারেন।
আমাদের সবারই কম বেশি মাথাব্যথা হয়। নানা কারণে মাথাব্যথা হতে পারে যেমন, একটু পানি কম খেলে, এক বেলা খাবার না খেলে, অনেক ক্লান্ত থাকলে, ঘুম কম হলে মাথা ব্যথা করতে পারে। প্রায় ১৫০টির মত মাথাব্যথার ধরন আছে। এগুলোর বেশির ভাগ দুশ্চিন্তার কারণ না, এমনিতেই চলে যায় কিন্তু এক ধরনের মাথাব্যথা হলে সেটা খুব দ্রুত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। তাই এ ধরনের মাথাব্যথা হলে কোন মতেই এড়িয়ে চলা যাবে না, সেটা কি ধরনের মাথাব্যথা?
শুরুতেই যে রোগীর কথা বলেছিলাম সেখানে ফিরে যাই, প্রতিদিন সাধারণত তিনি যা যা করেন সে দিনও তাই করছিলেন। মাথাব্যথা যখন শুরু হয় তখন তিনি চেয়ারে বসে বসে বই পড়ছিলেন। এই অবস্থায় হঠাৎ করে মাথার পিছন দিকে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। মনে হয় যেন কেউ হঠাৎ করে তার মাথায় একটা ইট দিয়ে বাড়ি দিয়েছে। এমন তীব্র মাথাব্যথা তার জীবনে কখনো হয়নি। তার একটু বমি বমি লাগে এবং তিনি কয়েক বার বমিও করেন। কয়েক ঘন্টা পর আস্তে আস্তে ব্যথাটা কমতে থাকে। মাথা ব্যথা থাকে তবে আগের মত এত তীব্র না, বমি ভাবটাও চলে যায়, একটু ভালো বোধ করতে শুরু করেন। তিনি আর হাসপাতালে আসেনি বা চিকিৎসকের কাছে যাননি। কিন্তু বাসার মানুষকে সে তার এই অদ্ভুত মাথা ব্যাথার কথা বলেছিল। কয়েকদিন পরে তার খিঁচুনি শুরু হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, তার মাথায় সিটি স্ক্যান করা হয়। এবং দেখা যায় যে তার মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ হয়েছিল অর্থাৎ স্ট্রোক হয়েছিল। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যাওয়াতে পরে চিকিৎসা করেও তাকে সুস্থ করে তোলা যায়নি।
তাহলে কোন ধরনের মাথাব্যথা হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে ….?
যদি আপনার মাথা ব্যথা খুব দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করে বা হঠাৎ করে প্রচন্ড মাথা ব্যথা শুরু হয় , যেটা এ রোগীর ক্ষেত্রে হয়েছিল। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো কত তাড়াতাড়ি আপনার মাথা ব্যথা তীব্র হচ্ছে। যদি মাথাব্যথা শুরু হওয়ার পরে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেটা খুব তীব্র হয়ে যায়, তাহলে সেটা দুশ্চিন্তার কারণ ইংরেজিতে যাকে বলে থান্ডারক্ল্যাপ হেডেক (thunderclap headache)। থান্ডারক্ল্যাপ শব্দের অর্থ হলো বজ্রপাত। অর্থাৎ বজ্রপাতের মত হুট করে বা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রচণ্ড মাথাব্যথা শুরু হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কয়েক সেকেন্ডেই মাথা ব্যথা তীব্র হয়ে পড়ে তবে কারও কারও ক্ষেত্রে কয়েক মিনিট। ১ থেকে ৫ মিনিট পর্যন্ত লাগতে পারে। কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিট যেটাই হোক আপনি দ্রুত হাসপাতালে যাবেন।
এখানে খেয়াল করেন সাধারণত আমাদের মাথাব্যথা কিন্তু এমন হয় না। প্রথমে আমাদের মাথা হালকা ব্যথা করা শুরু করে। কেউ কেউ বুঝতে পারেন এই বুঝি মাথাব্যথা শুরু হবে! তখন অনেকেই তো এটা সেটা করে কমানোর চেষ্টা করেন। তারপর অনেক সময় মাথাব্যথা সেরে যায়, অনেক সময় চলতে থাকে, আবার কখন কখনো আস্তে আস্তে মাথাব্যথা আরো তীব্র হতে থাকে। উপরে উল্লেখিত ধরনের মাথাব্যথার কথা এখানে বলা হচ্ছেনা। এটা থান্ডারক্ল্যাপ হেডেক (Thunderclap headache) না । শুরুতেই খুব তীব্র মাথাব্যথা হলে বা কয়েক সেকেন্ড অথবা কয়েক মিনিটেই প্রচন্ড হলে সেটাকে থান্ডারক্ল্যাপ বলা হয়।
এমন থান্ডারক্ল্যাপ মাথাব্যথার সাথে আরো কিছু লক্ষণ থাকতে পারে যেমনঃ
১) বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
২) আলোতে অস্বস্তি লাগতে পারে।
৩) রোগী আবোল-তাবোল বলা শুরু করতে পারে বা কনফিউশন।
৪) জ্ঞান হারানো বা রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারে।
৫) চোখে ব্যথা হতে পারে বা চোখের পাতার নিচে নেমে আসতে পারে।
৬) চোখে একটা জায়গায় দুইটা দেখা এমন হতে পারে।
৭) ঘাড় শক্ত মনে হতে পারে।
৮) খিঁচুনি হতে পারে। ইত্যাদি ।
এই মাথাব্যথার সাথে যদি আর কোন লক্ষন নাও থাকে তবুও দ্রুত হাসপাতালে যাবেন। কারণ কিছু রোগীর শুধুমাত্র এই “থান্ডারক্ল্যাপ” মাথাব্যথা ছাড়া আর কোনো লক্ষণ থাকেনা। কিন্তু তাদের মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।
এই জায়গাটিতেই অনেক রোগী ভুল করে। দেখা যায় কিছু সময় পার হলে মাথা ব্যথাটা একটু কমে যায়, শরীর ভালো লাগে, আর কোন সমস্যা নাই, তখন তারা মনে করেন যে ডাক্তারের কাছে যাবার দরকার নাই। মাথাব্যথা তো সেরে যাচ্ছে। এটা করবেন না। যেমন বজ্রপাতের মত মাথা হলে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে যাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ
এমন মাথা ব্যথা হলেই ঘাবড়ে যাবেন না। এই ধরনের মাথাব্যথা হওয়া মানেই যে বিপদ তা না। এমন অনেক কিছু কারণেও এ ধরনের মাথাব্যথা হতে পারে। তবে গুরুতর কিছু হওয়ার যেহেতু একটা সম্ভাবনা আছে তাই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। চিকিৎসক আপনার সাথে কথা বলে আপনার কিছু পরীক্ষা/পর্যবেক্ষন করে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন। তাঁকে অবশ্যই বলবেন যে, আমার হঠাৎ করে খুব তীব্র মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। এটা শুনে তিনি ব্রেনের রক্তক্ষরণের কথা চিন্তা করবেন, স্ট্রোকের কথা চিন্তা করবেন এবং সেই অনুযায়ী আপনাকে পরামর্শ দিবেন। আপনার ও আপনার পরিবারের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য জানতে এখানে ক্লিক্ করুন…