
ভাষা আন্দোলনের ১ম শহীদ রফিক।
ভাষা আন্দোলনের ১ম শহীদ রফিক
ভাষা আন্দোলন ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি নজিরবিহীন আন্দোলন। পাকিস্তানের শাসকরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রানের ভাষা বাংলাকে মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে, তৎকালীন গভর্নর জেনারেল, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেয় যে “উর্দু এবং শুধুমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। তার এ বক্তব্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মেনে নেয়না। বাংলাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দিতে হবে, এই দাবি পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল। ১৯৫২সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্র জনতার ওপর গুলি চালালে রফিক, সালাম, আবদুল জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকতসহ বহু যুবক শহীদ হন। আন্দোলনের তোপের মুখে পাকিস্তান সরকার নতিস্বীকার করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৫ সালের সংবিধানে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আজ আমরা ভাষা আন্দোলনের ১ম শহীদ রফিক এর কথা জানবো..
জন্ম ও পড়াশুনাঃ
১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের পারিল (বর্তমান রফিকনগর) গ্রামে শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আব্দুল লতিফ ও মাতা রাফিজা খাতুন দম্পতির পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে রফিক ছিলেন বড় সন্তান। রফিকের দাদার নাম মোঃ মকিম উদ্দিন। রফিক ১৯৪৯ সালে উপজেলার বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশ পাশ করে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে বাণিজ্য বিভাগ ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন।
রাজধানী ঢাকায় আগমনঃ
রফিকের বাবা আবদুল লতিফ তখন ঢাকায় মুদ্রণব্যবসার সঙ্গে জড়িয়েছেন নিজেকে। আর রফিকের ভগ্নিপতি মোবারক আলী হাজি ওসমান গনি রোডে শুরু করেছেন বই বাঁধাইয়ের কারখানা। রফিক ইতিমধ্যে দেবেন্দ্র কলেজের পাঠ অসম্পূর্ণ রেখে ভর্তি হয়েছেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার প্রেসের কাজ দেখাশোনা করছেন।
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। সে রাতে রফিক উদ্দিন গিয়েছেন ভগ্নিপতির কারখানায়।শহরজুড়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে —রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আগামীকাল ছাত্ররা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে জড়ো হবেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।
শহরের অন্য সবার মতো রফিক উদ্দিনের ভগ্নিপতি মোবারক আলী খান, তিনিও নিশ্চিত ছিলেন বড় কিছু একটা ঘটবে। তাই তিনি সংশয়ে এবং শঙ্কায় রফিককে মিছিল-মিটিংয়ে যেতে নিষেধ করলেন। মাঝরাতের দিকে রফিক উদ্দিন ফিরে গেলেন তার নিজেদের প্রেসে।
আন্দোলনে অংশগ্রহণঃ
রফিক তার একই গ্রামের মেয়ে রাহেলা খাতুন পানুকে ভালবাসতো এবং পরে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে ঠিক করা হয়। সেই উপলক্ষেই শহিদ রফিক বিয়ের বাজার করার জন্য ঢাকায় যান। ২১ শে ফেব্রুয়ারি রফিকের বিয়ের বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও তিনি তৎকালীন সরকার কর্তৃক আরোপিত ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ১৯৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে পাকিস্থানের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র জনতার সাথে তিনিও বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। এতো বড় একটা আন্দোলন থেকে কি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন রফিক? বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রয়াসে ১৪৪ ধারা ভাঙলেন।তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হোষ্টেল প্রাঙ্গন ও মিছিলের পদভারে প্রকম্পিত পুরো রাজপথ। এ অবস্থা দেখে পাকিস্থান সরকার দিশেহারা হয়ে উঠে। ফলে নির্বিচারে ছাত্র জনতার উপর গুলি বর্ষন শুরু হয় । ফাল্গুনের অপরাহ্নে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হওয়ার পর তিনি অবস্থান নিলেন মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাকের সামনের রাস্তায়। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করল, নিক্ষেপ করল টিয়ার গ্যাস, মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করল। তপ্ত, তিক্ত সেই গুলি রফিক উদ্দিন আহমদের মাথার খুলি উড়িযে দেয়, ছিটকে বরিয়ে যায় মাথার মগজ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে তিনিই প্রথম গুলিবিদ্ধ হন। ফলে সিংগাইরের কৃতিসন্তান রফিক উদ্দিন ভাষার জন্য প্রথম শহীদের মর্যাদা লাভ করেন।

মেডিকেল হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্বদিকে তার লাশ পড়ে ছিল। ছয় সাত জন আন্দোলনকর্মী তার লাশ এনাটমি হলের পেছনের বারান্দায় এনে রাখেন। তাদের মাঝে ডাঃ মোশাররফুর রহমান খান রফিকের গুলিতে ছিটকে পড়া মগজ হাতে করে নিয়ে যান। পাকিস্থান শাসক তাকে শহীদ করেও ক্ষান্ত হয়নি। তাঁর লাশ সেখান থেকে নিয়ে পুলিশ লুকিয়ে রাখে, পরে তার মৃতদেহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যায়। শহীদদের লাশ নিযে বড় ধরনের আন্দোলন হতে পারে এই ভয়ে পাকিস্তান সরকার শহীদ রফিকের লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে সেদিন রাত ৩টায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় তড়িঘড়ি করে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে শহীদ রফিককে সমাহিত করা হয়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রফিক উদ্দিনের আত্মত্যাগের জন্য ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর বুকে মর্যাদা পায় আন্তর্যাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে। এছাড়া তার গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রফিকনগর করা হয়। সিংগাইর ও মানিকগঞ্জে রয়েছে তাঁর নামে সড়ক। হেমায়েতপুর-সিংগাইরের ধলেশ্বরী নদীর উপর শহীদ রফিক সেতু নির্মিত হয়েছে। এবং গ্রামে তার নামে ‘ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভবনের নাম ‘ভাষাশহীদ রফিক ভবন’ নামকরণ করা হয়।
ইতিহাস বিষয়ে আরো জানতে এখানে ক্লিক্ করুন…