ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
ভাষা আন্দোলন (The language Movement)
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। কিন্তু এই মাতৃভাষা কে কেড়ে নেওয়ার জন্য কতো জল্পনা-কল্পনা করছে পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী। কিন্তু বীর ছেলেরা প্রাণের ভাষা, আমাদের মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে দেয়নি। লড়াই করে গেছে নিজের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত। আজ ভাষা আন্দোলন এর কিছু ইতিহাস জেনে নেওয়া যাকঃ
১।১৯০১ সালে রংপুরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলা ভাষাকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকারের আহবান জানান।
২। পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা । পক্ষান্তরে সমগ্ৰ পাকিস্তানে উর্দু ভাষাভাষীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৬ ভাগ ।
৩। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় জনাব তাসাদ্দুক হোসেন সভাপতিত্বে পূর্বপাকিস্তান যুবকর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।এ সম্মেলনেই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের অফিস ও আইন আদালতের ভাষা এবং শিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলাকে চালু করার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্ৰহণ করা হয়।
৪। ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ( তমদ্দুন মজলিশ ) – ( Tamuddun Majlis ) নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে চালু করার দাবি নিয়ে এগিয়ে আসে ( তমদ্দুন মজলিশ ) । তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ( পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ) প্রকাশ করে । এ পুস্তিকার লেখক ছিলেন তিনজন- অধ্যাপক আবুল কাসেম, ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন এবং আবুল মনসুর আহমদ।
৫। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় ( রাষ্ট্রভাষা সংগ্ৰাম পরিষদ ) ( State Language Movement Association ) গঠিত হয়।
৬। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান প্রথম গণপরিষদ অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু ভাষাতে অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হলে পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষারূপে সরকারী স্বীকৃতির দাবি জানান।কিন্তু গণপরিষদ এ দাবি প্রত্যাখ্যান করলে পূর্ব বাংলার ছাত্র শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী মহলে অসন্তোষ দেখা দেয়।
৭। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ কামরুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে ( সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ) ( All Parties State Language Movement Association ) গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে সরকারের ষড়যন্ত্র রোধ করার জন্য ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়।ঐ দিন ঢাকায় বহুছাত্র আহত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকে গ্ৰেফতার হন।একজন্য ১৯৪৮ – ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময়কালে প্রতি বছর ১১ মার্চ ( ভাষা দিবস ) ( Language day) হিসেবে পালন করা হত।
৮। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন ( উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ) ২৪ মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে উপস্থিত ছাত্ররা ( না না ) বলে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
৯। ১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে ইসলামী আদর্শের খাতিরে বাংলা ভাষার জন্য ( আরবি হরফ ) বা প্রকান্তরে ( উর্দু হরফ ) গ্ৰহণের প্রস্তাব করা হয়।
১০। ১৯৪৯ সালে পূর্ব বাংলা সরকার বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে ( পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি ) গঠন করে। মওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন এ কমিটির সভাপতি।
১১। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঘোষণা করেন ( উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে )।
১২। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এক জনসভায় ( উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ) ঘোষণা করেন ।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন
১। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ঐ দিনই আর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে ( সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ) ( All Parties State Language Movement Committee ) গঠন করা হয়।
২। ( সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ) ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রোজ বৃহস্পতিবার ( রাষ্ট্রভাষা দিবস ) পালনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সারাদেশে হরতাল কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করে। ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে ভীত হয়ে নুরুল আমিন সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সসংগঠিভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ( রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ) শ্লোগান দিতে দিতে বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে সমবেত হয়। পুলিশ উপস্থিত ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করলে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ এক পর্যায়ে গুলি বর্ষণ করলে সালাম,বরকত,রফিক,জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন।
৩। পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিশাল শোভা যাত্রা বাহির হয়। এ শোভাযাত্রাযর উপরও পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ফলে শফিউর রহমান মৃত্যুবরণ করেন।
৪। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন এবং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমিন।
৫। পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন মালিক মোহাম্মদ ফিরোজ খান নুন ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ।
৬। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করা হয়।
৭। ভাষা শহীদ আবুল বরকত ১৯২৭ সালে মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ভাষার জন্য আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয় ।
মাতৃভাষা চির-অম্লান হয়ে থাকুক আমাদের সকল বাঙালির প্রাণে।
#ভাষা আন্দোলন #ভাষা আন্দোলন #ভাষা আন্দোলন