
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও আমাদের ভবিষ্যৎ
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি?
প্রকৃত অর্থে বাস্তব নয় কিন্তু বাস্তবের চেতনা উদ্রেককারী বিজ্ঞাননির্ভর কল্পনাকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা অনুভবে বাস্তবতা কিংবা কল্পবাস্তবতা বলে। একে সংক্ষেপে VR বলা হয়ে থাকে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মূলত কম্পিউটার প্রযুক্তি ও সিমুলেশন তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এতে ব্যবহৃত সফটওয়্যারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: Vizard, VRToolKit, 3d Studio Max, Maya ইত্যাদি।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ত্রি-মাত্রিক ইমেজ তৈরির মাধ্যমে অতি অসম্ভব কাজও করা সম্ভবপর হয়। কল্পনার পাখায় ভর করে ইচ্ছে করলে চাঁদের মাটিতে হেঁটে আসা, প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম অঞ্চলে ঘুরে আসা, মানুষের মস্তিষ্কের নিউরাল সংযোগের উপর দিয়ে হাঁটা কিংবা জুরাসিক পার্কের সেই অতিকায় ডায়নোসরের তাড়াও খাওয়া যায়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি একটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ যেখানে ব্যবহারকারী ঐ পরিবেশে মগ্ন হতে, বাস্তবের অনুকরণে সৃষ্ট দৃশ্য উপভোগ করতে, সেই সাথে বাস্তবের ন্যায় শ্রবণানুভূতি এবং দৈহিক ও মানসিক ভাবাবেগ, উত্তেজনা অনুভূতি প্রভৃতির অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ইতিহাসঃ
(১) ফরাসি নাট্যকার, কবি, অভিনেতা ও নির্দেশক অ্যান্টোনিম আরচিউড ( Antonim Artaud ) এর ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত গ্ৰন্থ The Theater and It’s Double – এ তিনি সর্বপ্রথম ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে ডেমিয়েন ব্রডরিক ( Damien Brodrick ) এর The Judas Mandala নামক সায়েন্স ফিকশনেও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল।
(২) ১৯৬১ সালে মর্টন এল হেলিগ তার সেন্সোরামা স্টিমুলেটর নামক যন্ত্র দিয়ে প্রথম বাস্তব উপায়ে ভার্চুয়াল রিয়েলিটিকে উপস্থাপনা করেলেও এর সাথে কম্পিউটারের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
(৩) আধুনিক ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয় ১৯৮০ সাল থেকে। ১৯৮৪ সালে হ্যাকার লেনিয়ার তার ভিপিএল রিসার্চ কর্পোরেশনে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন যা আজকের ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তির জন্ম দিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তিতে গুরুত্বের সাথে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয় সেগুলো হলোঃ
- শব্দ : ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে শব্দ কোন বিশেষ স্থান থেকে উৎসারিত এবং ডায়নামিক বা পরিবর্তনশীল বলে মনে হয়। এর কারণ এই প্রযুক্তিতে ত্রিমাত্রিক শব্দ যুক্ত করা হয় যাতে করে শব্দের কারণে এক ধরনের পরাবাস্তব ত্রিমাত্রিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
- দৃষ্টি : চশমা কিংবা হেলমেটের মধ্যে ছোটো আকারের পর্দা থাকে এবং বহুমাত্রিক ডিসপ্লে ব্যবহৃত হয়। এতে করে ব্যবহারকারী একেবারে বাস্তবের ন্যায় অথচ পরাবাস্তব ( কল্পবাস্তব ) দৃশ্য অবলোকন সক্ষম হয়।
- মস্তিষ্ক : মানুষের মস্তিষ্কের ওপর পরিচালিত গবেষণা কম্পিউটার জেনারেটেড ওয়ার্ল্ডকে নতুন অবয়ব দিয়েছে, যার সাহায্যে তথ্যকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করা যায় এবং কৃত্রিমভাবে তার অনুভূতি মস্তিষ্কের জন্য প্রেরণ করা সম্ভব হয়। যার জন্য মস্তিষ্কে বিভিন্ন কৃত্রিম স্টিমুলেশন প্রদান করা হয়ে থাকে ফলে নানা পরাবাস্তব দৃশ্যে চিত্রের মাধ্যমে কৃত্রিম অনুভূতি বাস্তবের ন্যায় সৃষ্টি করা সম্ভব হয়ে থাকে।
- স্পর্শ : ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের জুতা, গ্লাভস বা শরীরের বিশেষায়িত পোশাক একজন ব্যক্তিকে কৃত্রিমভাবে প্রকত বাস্তবের ন্যায় অবস্থার কাছাকাছি নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
- টেলিপ্রিজেন্স : উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার গ্ৰাফিক্স ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক দূর থেকে কাজ পরিচালনার প্রক্রিয়াকে টেলিপ্রিজেন্স বলা হয়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে টেলিপ্রিজেন্স প্রক্রিয়ায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। যেমন- এক্ষেত্রে বৈমানিকগণ আসল বিমান চালানোর পরিবর্তে হুবহু আসলের ন্যায় কৃত্রিম বিমান পরিচালনায় ভার্চুয়াল পরিবেশে ট্রেনিং গ্ৰহণ করতে পারেন বা ড্রাইভারগণ কৃত্রিমভাবে তৈরি বাস্তব সদৃশ পরিবেশে প্রাক ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সুফলঃ
- ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে বিভিন্ন কার্যক্রম যৌক্তিকভাবে খরচ কমিয়ে সাশ্রয়ী উপায়ে কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব।
- বাস্তবায়নের পূর্বেই পরিবেশ, পরিস্থিতি ও ফলাফলকে কৃত্রিমভাবে অনুভব করা যায়। তাই অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত, অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয় ঘটনাকে রোধ করতে ভূমিকা রাখে।
- যে কোনো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে আকর্ষণীয়, হৃদয়গ্ৰাহী, বাস্তবসম্মত এবং সর্বোচ্চভাবে নিরাপদ করতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ যে কোনো প্রশিক্ষণে দুর্ঘটনা, প্রাণনাশ প্রভৃতির সম্ভাবনা শূন্যে নামিয়ে আনে।
- সামরিক প্রশিক্ষণ, মহড়া, কোনো উৎপাদিত ধ্বংসাত্মক পণ্যসমূহের মান যাচাইয়ের পরীক্ষাসমূহ বিষয়টি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে সম্পন্ন করা হলে তা পরিবেশ দূষণ ও বিপর্যয় রোধ করে।
- ঝুঁকিপূর্ণ উৎপাদন ব্যবস্থাকে সহজ সরল ও ঝুঁকিহীন করে তোলে।
প্রাত্যহিক জীবনে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির নেতিবাচক প্রভাব( Negative Influence of VR in everyday life )
ইতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি ভার্চুয়াল রিয়েলিটির নেতিবাচক প্রভাব ও রয়েছে। এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
- চড়া দাম এবং জটিলতা -ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সরঞ্জামাদির দাম অনেক চড়া হওয়ার কারণে সাধারণের মধ্যে এর প্রসার এবং জটিলতা নিয়ে বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্নতায় আছেন। অনেক সময় এর হ্যান্ডসেটের গতি ব্যবহারকারীর স্বাভাবিক গতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে না।
- স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর – বিভিন্ন গবেষণা করে দেখা গেছে যে, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এর ব্যবহার মানুষের জন্য বড় ক্ষতি হতে পারে। এটি মানুষের দেখার শক্তি ও কানে শোনার শক্তির ক্ষতি করতে পারে।
- কল্পনার জগতে বিচরণ – ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে মানুষ তার কল্পনার রাজ্যে ইচ্ছেমতো বিচরণ করতে পারবে। অনেক সময় ধরে কল্পনার জগতে থাকলে বাস্তবতা থেকে আস্তে আস্তে দুরে সরে যাবে। ফলে পৃথিবীতে বিপর্যয় নেমে আসবে।
Science & Technology সম্পর্কে আরো জানতে এখানে ক্লিক করুণ…