বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস-০২
পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র(The first Constitution of Pakistan)এর আলোচনাঃ
পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র রচিত হয় ১৯৫৬ সালে। এ শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র নাম ধারণ করে। পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোকে একত্রিত করে একটি ইউনিট গঠনের ফলে এর নাম হয় ( পশ্চিম পাকিস্তান ) এবং পূর্ব বাংলার নাম হয় ( পূর্ব পাকিস্তান )। পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন ইস্কান্দর মীর্জা।
কাগমারী সম্মেলন (Kagmari Conference) এর কিছু কথাঃ
১৯৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যা ( কাগমারী সম্মেলন ) নামে পরিচিত। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সম্মেলনের প্রধান এজেন্ডা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, যদি পূর্ব পাকিস্তানে শোষণ অব্যাহত থাকে তবে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে (সালাম ) জানাতে বাধ্য হবেন।
সামরিক শাসন জারি(Promulgation of Martial law ) এর কিছু কথাঃ
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর এক ঘোষণাবলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে প্রথম সামরিক শাসন জারি করেন। তিনি প্রধান সেনাপতি জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। মাত্র ২০ দিনের মাথায় তিনি প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং দেশত্যাগে বাধ্য করেন। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান নিজেকে পাকিস্তানের স্বনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। আসলে তিনি পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি ও সামরিক শাসকের পদেও বহাল থাকেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬০ সালের ২৩ মার্চ সামরিক শাসন প্রত্যাহার করেছিলেন।
পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র(The Second Constitution of Pakistan) এর কিছু কথাঃ
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬২ সালে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সংবিধান প্রণীত হয়। এ সংবিধানে পাকিস্তানকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় পাকিস্তানের রাজধানী করাচি থেকে ইসলামাবাদে স্থানান্তর করা হয়।
হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন(Movement against Hamidur Rahman Education Commission) এর কিছু কথাঃ
ছাত্ররা ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গণতান্ত্রিক শিক্ষার দাবিতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং স্বৈরাচার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রথম গগঅভ্যুত্থান।
১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন(The President election of 1965 ) এর কিছু কথাঃ
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেন এবং নিজে কনভেনশন মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন। এমতাবস্থায় অধিকাংশ বিরোধী দল মিলিত হয়ে ( কপ ) ( COP = Combined Opposition Party ) নামে একটি সম্মিলিত জোট গঠন করে। এ জোটের প্রার্থী ছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাগ্নী ফাতেমা জিন্নাহ। এ নির্বাচনে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রী পন্থায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ(The Indo-Pak War of 1965 ) এর কিছু কথাঃ
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাশ্নীর প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে অবনতি ঘটে। ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হয় পাক-ভারত যুদ্ধ। ১৭ দিন ব্যাপী এ যুদ্ধে বাঙালী সৈন্যরা অসম্ভব সাহসিকতা দেখায়। অতঃপর জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে উভয়পক্ষের যুদ্ধ বিরতি হয়।
জেনে রাখা ভালো
পূর্ব বাংলার গভর্নর ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক।
১৯৫৬ সালের ২৪ মার্চ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক পূর্ব বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন ( অপসারিত হন ৪ এপ্রিল ১৯৫৮ ) এছাড়াও তিনি অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণাবলী ও প্রগাঢ় জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ( ডক্টর অব ল ) ডিগ্ৰি প্রদান করে।
ছয়-দফা দাবি(The Six-Points Movement) এর কিছু কথাঃ
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষার দাবি সংবলিত একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ইতিহাসে এটি ৬ দফা কর্মসূচি নামে পরিচিত। পরবর্তীতে ২৩ মার্চ, ১৯৬৬ লাহোরের এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা ঘোষণা করেন। ছয় দফা কর্মসূচি ঐতিহাসিক ( লাহোর প্রস্তাব ) এর ভিত্তিতে রচিত। ছয় দফা দাবির প্রথম দাবি ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন। ছয় দফা কর্মসূচী বাঙালি জাতির ( মুক্তির সনদ )
( Charter of Freedom ) / ( ম্যাগনাকার্টা ) হিসেবে পরিচিত। এর প্রথম দফা ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা(The Agartala Conspiracy Case) এর কিছু কথাঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহযোগীরা ভারতের সহায়তায় সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে ভারতের আগরতলায় ষড়যন্ত্র করেছে, এমন অভিযোগ এনে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মামলা দায়ের করে। আইয়ুব খানের শাসনামলে এ মামলা ( আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ) নামে পরিচিত। এ মামলার শিরোনাম ছিল ( রাষ্ট্রদ্রোহিত বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য )। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় এই মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলার মোট আসামি ছিলেন ৩৫ জন এবং প্রধান আসামি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমির হোসেন এ মামলার খবর ফাঁস করে দেন। এ মামলার বিচারকার্যের জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি এস.এ.রহমানের নেতৃত্বে ঢাকায় একটি বিশেষ আদালত গঠন করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে এ মামলার বিচারকার্য শুরু হয়।
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি আসাদুজ্জামান নামের এক ছাত্রনেতা, ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ।
১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন(The General Election of 1970) এর কিছু কথাঃ
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের নিকট ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতি থেকে সরে দাড়ান। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ রাতে সারা দেশে দ্বিতীয় বারের মতো ( মার্শাল ল ) জারি করেন। লো ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্ৰহণের পর জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন। পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় পরিষদ নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর।
( স্বাধীনতার ইশতাহার ) ঘোষণা
একাত্তরের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে আ.স.ম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন এ চার নেতা মিলে এক বৈঠকে ( স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্ৰাম পরিষদ ) গঠন করেন। একাত্তরের ৩ মার্চ ছাত্র সংগ্ৰাম পরিষদ আহূত পল্টন সমাবেশে ( স্বাধীনতার ইশতাহার ) পাঠ করা হয়। এতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ( জাতির পিতা ) ঘোষণা করা হয়।
১ম অংশঃ