পুষ্টির অভাবজনিত রোগসমূহ
খাদ্য আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজন। দেহের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য দরকার। এর জন্য দরকার পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য। যেন খাদ্য সুষম খাবার হয় সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার না খেলে আমাদের অনেক রোগ হতে পারে।
রাতকানা ( Night Blindness )
ভিটামিন (এ)- এর অভাবে চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জেরোফথ্যালমিয়া ( Xerophthalmia ) নামক রোগ হয়। ভিটামিন (এ)- এর অভাব পূরণ না হলে রোগটির মাত্রা ও তীব্রতা বাড়তে থাকে। জেরোফথ্যালমিয়ার সাত থেকে আটটি মাত্রা রয়েছে, যার সর্বনিম্ন মাত্রা হচ্ছে রাতকানা। সাধারণত দুই থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা দেয়।
এতে চোখের সংবেদি ( রড ) কোষগুলো ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়, স্বল্প আলোতে ভালো দেখতে পায় না। চোখে সবকিছু ঝাপসা দেখা যায়। রোগটা বেড়ে গেলে কর্নিয়া ঘোলাটে হয়ে যায়। রাতকানা দশা থেকে শুরু করে চতুর্থ বা পঞ্চম মাত্রায় জেরোফথ্যালমিয়া ভিটামিন (এ)- সহ কিছু ওষুধ প্রয়োগ ভালো হয় কিন্তু রোগ চূড়ান্ত মাত্রায় বা তার কাছাকাছি পৌঁছে গেলে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার ছাড়া আর তেমন কিছু করার থাকে না।
এই রোগ প্রতিরোধের জন্য ভিটামিন (এ)- সমৃদ্ধ খাদ্য, যেমন : মাছের যকৃতের তেল, কলিজা, সবুজ শাকসবজি, রঙিন ফল ( পাকা আম, কলা ইত্যাদি ) ও সবজি ( মিষ্টি কুমড়া, গাজর ইত্যাদি ) এবং মলা-ঢেলা মাছ খাওয়া উচিত।
রিকেটস ( Rikets )
এটি কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ নয়, ভিটামিন (ডি) এর অভাবে এ রোগ হয়। অন্ত্রে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষণ, দাঁত ও হাড় গঠন প্রভৃতি শারীরবৃত্তীয় কাজে এই ভিটামিন প্রয়োজন। দুধ, মাখন, ডিম, কডলিভার তেল ও হাঙ্গরের তেলে প্রচুর ভিটামিন (ডি) পাওয়া যায়। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে মানুষের ত্বকে জমা থাকা কোলেস্টেরল থেকেও এটি তৈরি হয়, তবে সেক্ষেত্রে ভিটামিন (ডি) তৈরির শেষ ধাপটি সংঘটিত হয় কিডনিতে।
দেহের হাড়গুলো দুর্বল হওয়া, গিঁট ফুলে যাওয়া, হাড়গুলো বিশেষ করে পায়ের হাড় বেঁকে যাওয়া ইত্যাদি এ রোগের লক্ষণ। এছাড়া এই রোগে অনেক সময় দেহের কাঠামো ঠিক থাকে না, হাড়গুলো ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং বক্ষদেশ সরু হয়ে যায়। শিশুদের পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন (ডি) সমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে। চোখ এবং জননাঙ্গ ঢেকে রেখে নবজাতককে কিছুক্ষণ রোদে রাখা ভালো। এতে সূর্যালোকের অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে শরীরে কোলেস্টেরল থেকে ভিটামিন (ডি) তৈরি হয়।
নিয়মিতভাবে সারা শরীর সারা দিন কালো বা গাঢ় রঙের কাপড়ে ঢেকে রাখলে কিংবা অনেকদিন ধরে ঘরের বাইরে না বের হলে ত্বক সঠিক পরিমাণে সূর্যের আলো পায় না এবং এ কারণে ভিটামিন (ডি)- এর অভাব দেখা দেখা দেয়।
গয়টার ( Goitre )
প্রচলিত অর্থে গলগন্ড বলতে থাইরয়েড গ্রন্থির যেকোনো ফোলাকে বোঝায়। গলগন্ডের কিছু বিশেষ ধরনকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে গয়টার নামে বাঁকা হয়, অর্থাৎ সব গলগন্ড গয়টার নয়। টিউমার, ক্যান্সার, প্রদাহসহ নানা কারণে থাইরডের ফুলে যেতে পারে, সেগুলো গয়টার নয়।
আবার, গয়টার থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো নির্দিষ্ট রোগ বোঝায় না, বরং থাইরয়েডের বিভিন্ন রোগের এক সাধারণ বহিঃপ্রকাশকে বোঝায়। নানা কারণে গয়টার হতে পারে। খাবারে আয়োডিনের অভাব গয়টার তথা গলগন্ডের অন্যতম কারণ। সমুদ্র থেকে দূরে উত্তর বঙ্গ এবং পার্বত্য এলাকার মাটিতে আয়োডিন কম থাকায় ওই সব অঞ্চলের মানুষের এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
রক্তশূন্যতা ( Anemia )
আমাদের দেশে শিশু ও নারীদের ক্ষেত্রে রক্তস্বল্পতা বা শূন্যতা একটি সাধারণ রোগ। রক্তশূন্যতা হচ্ছে দেহের এমন একটি অবস্থা, যখন বয়স এবং লিঙ্গভেদে রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘনত্ব স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়। খাদ্যের মুখ্য উপাদান লৌহ, ফলকি অ্যাসিড, ভিটামিন (বি)- 12 ইত্যাদির অভাব ঘটলে এ রোগ দেখা যায়। রক্তস্বল্পতার শতাধিক কারণ জানা গেছে এবং পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি না হয়েও রক্তস্বল্পতা হতে পারে।
তবে বাংলাদেশে সাধারণত লৌহের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা বেশি হয়। শিশুদের, প্রজননের উপযুক্ত বয়সী নারীদের ( 15-45 বছর ) এবং গর্ভবতীদের এই রোগ বেশি হয়।
লৌহের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা বা রক্তশূন্যতা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যেমন :
১। অত্যাধিক রক্তপাত ঘটলে।
২। কৃত্রিম আক্রমণে।
৩। লৌহ গঠিত খাদ্য উপাদান শরীরে যথাযথভাবে শোষিত না হলে।
৪। বাড়ন্ত শিশু বা গর্ভবতী নারীদের খাদ্যে লৌহের পরিমাণ কম থাকলে।
৫। অন্ত্রে সংক্রামণ ঘটলে, কম বয়সী শিশুদের খাদ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ লৌহের অভাব হলে।
রক্তশূন্যতা হলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দেয়ঃ
১। দুর্বলতা অনুভব করা,
২। মাথাব্যথা, মনমরা ভাব,
৩। অনিদ্রা, চোখ অন্ধকার দেখা,
৪। খাওয়ার অরুচি, বুক ধরপর করা ইত্যাদি।
এ রোগ প্রতিরোধের জন্য লৌহসমৃদ্ধ খাবারঃ
১। যকৃৎ, মাংস, ডিম, চিনা বাদাম, শাক-সবজি, বরবটি, মসুর ডাল, খেজুরের গুড় খেতে হয়।
২। পরীক্ষা করে অন্ত্রে কৃত্রিম বা হুকওয়ার্ম-এর সংক্রমণ নিশ্চিত হলে কৃমিনাশক ঔষধ সেবন করা যায়।
৩। প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী লৌহ উপাদান যুক্ত ওষুধ সেবন করে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হয়।
৪। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রক্তস্বল্পতার চিকিৎসা করা বিপজ্জনক হতে পারে।
কেননা রক্তস্বল্পতার এমন কিছু ধরন ( যেমন: থ্যালাসেমিয়া ) রয়েছে, যেখানে প্রচলিত মাত্রায় লৌড়জাতীয় ওষুধ বা খাদ্য গ্ৰহণ করলে রোগী আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই রক্তস্বল্পতার চিকিৎসা শুরু করার আগে তার সঠিক কারণ নির্ণয় করা আবশ্যক।