বিশ্ব ঐতিহ্যের বাংলাদেশঃ পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার
১)বিশ্ব ঐতিহ্যের বাংলাদেশঃ পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহারঃ

অবস্থানঃ
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত রাজশাহী বিভাগ। রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত ১৩৩৭ বর্গ মাইলের এক বিশাল আয়তনের একটি সমৃদ্ধ জেলা-নওগাঁ । যা ধারণ করে আছে পুরাকৃর্তী। নওগাঁ জেলায় অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থান আছে । অধিকাংশ পরিচিত হলেও অনেক দর্শনেরই ইতিহাস বা তথ্য আজও উৎঘাটিত হয়নি। ইউনেস্কো ঘোষিত সারা বিশ্বে ৭৫০ টি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে নওগাঁ জেলার সোমপুর মহা বিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বাংলাদেশের একটি অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষনা পায় ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে । এটি ধঃ হিমালয়ের ২য় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহারও বটে। নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলা সদর থেকে আট মাইল উত্তর-পূর্বে এবং জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৫ কিমি পশ্চিমে এগৌরবময় ও দর্শনীয় স্থান সোমপুর মহা বিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার অবস্থিত।
পিছনের ইতিহাসঃ
সপ্তম শতাব্দিতে অর্থাৎ ৭৭০ থেকে ৮১০ খ্রিষ্টাব্দে বৌদ্ধ ধর্মীয় পাল রাজ বংশের প্রতিষ্ঠা হয়। পাল বংশের ২য় ও শ্রেষ্ঠ রাজা হিসাবে পরিচিত ধর্মপাল ও তার পুত্র দেবপাল অষ্টম শতকের শেষের দিকে অর্থাৎ অষ্টম ও নবম শতাব্দিতে (৭৮১-৮২১) এই বিহার নির্মান করেন। সে সময় তারা বাংলা, বিহার এবং কনৌজ পর্যন্ত বিরাট সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় বৌদ্ধ ধর্মের চরম উৎকর্ষতার যুগ বলে ধরা হয়। প্রায় ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করা হতো। সে সময় শুধূ এ উপমহাদেশই নয় বরং তীব্বত, মায়ানমার ও চীন ইন্দোনেশিয়া,মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন।

খনন কার্যঃ
ইংরেজ প্রত্নতাত্তিক ফ্রানসিস বুকানন হ্যামিলটন ১৮০৭ থেকে ১৮১২ সালের মধ্যে পূর্ব ভারত জরিপের সময় এই বিহার র্কীতি বৌদ্ধ বিহার বলে অনুমান করেন। ইউকিপিডিয়ার তথ্য মতে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ সালে এই বিশাল স্থাপনা আবিষ্কার করেন। ১৯২৩ সালে এই বিহারের খনন কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯৩৩-১৯৩৪ সালের দিকে। খনন কালে প্রাপ্তী একটি মাটির সীল থেকে জানা যায় এ বৌদ্ধ বিহারের নাম সোমপুর বৌদ্ধ বিহার । এর গ্রাত্রে ৬৩টি বিভিন্ন চিত্রাবলীর টেরাকোটা দেখা যায়।

আয়তনঃ
মোট ৮১ বিঘা বা ২৭ একর (কম/বেশী ১০ হেক্টর) জমির উপর এই সোমপুর বিহার অবস্থিত। সোমপুর বিহার এশিয়া মহাদেশের সব চেয়ে বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার।ভারতের নালন্দা মহাবিহারের আয়তনের তুলনা করা যেতে পারে। যার আয়তন উত্তর-দক্ষিনে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট। মূল দালানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য ১৭৭ টি কক্ষ ছিল। যা ৮০০ জন ভিক্ষুর বাস উপযোগী ছিলো। উন্নত স্থাপত্য কলা কৌশলে নির্মিত বিহারের বর্তমান উচ্চতা ৭০ ফিট। পিরামিড আকৃতির মন্দিরের জটিল সংযোনাবলী একটি শূণ্য কক্ষ চতুস্কোন কক্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে হয়েছিল। এর প্রবেশ পথ ও মূল দালানে উঠার সিরি ছিল উত্তর দিকে এবং সমস্ত বিহারটি ছিল প্রচিীর বেষ্টিত। পাল রাজাদের প্রতিষ্ঠিত এসব বিহার জ্ঞান সাধনা ও জ্ঞান বিস্তারের উদ্দেশে নির্মান করা হয়েছির বলে ধারনা করা হয়। বহু জ্ঞানীগুণীদের পদচারনায় মুখরিত ছিল এই বিহার। মহা পন্ডিত আচার্য ও বদি চন্দ্র এই সোমপুর বিহারে বাস করতেন। আচার্য অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানও দশম শতকের দিকে বিহারে কিছুকাল বাস করেছিলেন অর্থাৎ আচার্য ছিলেন । সেই সাথে তাঁর গুরু রত্নাকর সন্তি সোমপুর বিহারের মহা পন্ডিত ছিলেন। প্রাচীন চর্চা গীতীকার কার্ণপা ও তাঁর গুরু জলনদলীপা ওরফে হারিপা এ বিহারে অবস্থান করতেন। পাল রাজ্যত্যের অবসান ঘটিয়ে সেনদের রাজ্যত্য কালে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এ বিহার ছেড়ে নেপাল, তিব্বত সহ পার্শ্ববর্তী অনেক দেশে পালিয়ে যান। সেনদের হটিয়ে মুসলিম শাসকদের আগমন ঘটলে বিহারের কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এখন কালর আবর্তে এ বিহারটি একটি ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়।
বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভূক্তিঃ
বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভূক্তির পর সোমপুর বৌদ্ধ বিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার সংরক্ণ কাজে আনেক অর্থ ব্যায় করা হলেও পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক ও সংরক্ষনবিদের অভাবে এ মহা বিহারের সংরক্ষন যথাযথ ভাবে সঠিক নীতিমালা অনুযায়ী সম্পন্ন করা হয়নি। তাই সিমেন্ট ইট, নয়া পোড়ামাটির ফলক ইত্যাদী যোগ করার কারনে প্রাচীন এ বৌদ্ধ বিহারটি হারিয়েছে তার আদি রুপ ও বৈশিষ্ট্য । তারপরও বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক সোমপুর বৌদ্ধ বিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিদিন-ই হাজির হন অসংখ্য পর্যটক।

২) হলুদ বিহারঃ
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার হতে মাত্র ১৪কিঃমিঃ দক্ষিনে ক্ষুদ্রাকৃর্তির আর একটি বৌদ্ধ বিহার আছে তা হলুদ বিহার নামে পরিচিত। এই হলুদ বিহারটি বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার বদলগাছী উপজেলার বিলাশবাড়ী ইউনিয়নের দ্বীপগঞ্জ গ্রামে অবস্থিত। ঐতিহাসিকগন মনে করেন্ এই বিহারটি পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের সম-সাময়িক কালের। এর উচ্চতা মূল ভূমি হতে প্রায় ২৫ ফুট।
যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ
নওগাঁ বালুডাংগা বাস টার্মিনাল হতে সরাসরি বাসযোগে ঐতিহাসিক পাহাড়পুরে যাওয়া যায় |আনুমানিক দূরত্ব আনুমানিক ৩২ কিঃমিঃ।
জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৫ কিঃ মিঃপশ্চিমে।