
সূর্যকে ছুঁয়েছে নাসার সৌরযান পার্কার !
সূর্যকে ছুঁয়েছে নাসার সৌরযান পার্কার
নাসার পাঠানো এক মহাকাশযান প্রথমবারের মতো সূর্যকে ছুয়ে ফেলেছে। শুধু তাই নয় এখান থেকে কুড়িয়ে এনেছে নমুনাও। মহাকাশ বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন ঘটনা এবারই প্রথম।
পার্কার সোলার প্রোব (Parker Soar Probe)
১৯৫৮ সালে সর্বপ্রথম সূর্যের উদ্দেশ্যে সৌর যান পাঠানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল কিন্তু এই কঠিন পথে ভ্রমণ করার মতো প্রযুক্তি ২০০০ সালের আগে মানুষের কাছে ছিল না। ২০১৮ সালের আগস্টের ফ্লোরিডার কেপকেনাভেরাল থেকে নাসা একটি সৌরযান উৎক্ষেপণ করে। এই যানের নাম পার্কার সোলার প্রোব (Parker Soar Probe) বেশ কয়েকবছর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার পর অবশেষে সৌরযানটি সৌরজগতের সূর্য পৌঁছাতে পেরেছে। পার্কার মিশন এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সূর্যের করোনা অঞ্চলের ভিতর দিয়ে উড়ে যাওয়া।
করোনা অঞ্চলঃ
সূর্যের এই করোনা অঞ্চল সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে হলে সূর্যের গঠন সম্পর্কে জানতে হবে। আমাদের পৃথিবীর মতো সূর্যপৃষ্ঠে কঠিন নয় সূর্য মূলত প্লাজমা দ্বারা গঠিত। প্লাজমা হলো পদার্থের চতুর্থ অবস্থা অর্থাৎ এটি কঠিন তরল গ্যাস কোনোটিই নয়। সূর্যের প্লাজমা অভিকর্ষ বলের কারণে একে অপরের সাথে লেগে থাকে। তারপরও বেশকিছু সৌর পদার্থ সূর্য থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে এসব পদার্থের চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা আবদ্ধ হয়ে সূর্যের বায়ুমণ্ডল সৃষ্টি করে। সুর্যের এই আবহাওয়ায় করোনা হিসেবে পরিচিত। সূর্য থেকে বিক্ষিপ্ত পদার্থ করোনা অঞ্চল ভেদ করে মহাকাশেও ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোকে বলা হয় সোলার উইন্ড (Solar Wind) বা সৌর বাযু। যেখানে সূর্যের বায়ুমণ্ডল শেষ হয় সেই সীমাকে বলা হয় আল্ফভেন ক্রিটিক্যাল সারফেস (Alfvan critical surface)। এই প্রথমবারের মতো মানুষের তৈরি কোন বস্তু সূর্যের বায়ুমণ্ডল ভেদ করে সরাসরি সূর্যের ভেতরে প্রবেশ করেছে।
সূর্যের করোনা অঞ্চল এতোই পাতলা যে, সহজে বোঝা যায় না। কয়েক শতাব্দী ধরে সূর্য-গ্রহণের সময় সূর্যের বায়ুমণ্ডল পরীক্ষা করতে গিয়ে সূর্যের করোনা অঞ্চল ধরা পড়েছে। কিন্তু সূর্যের করোনা এখনো পর্যন্ত রহস্যই রয়ে গেছে। সূর্য আমাদের সৌরজগতের উপর কেমন প্রভাব ফেলে তা বোঝার জন্যই করোনা গবেষনা জরুরী। করোনা থেকে প্রতিনিয়ত ১০ লক্ষ মাইল প্রতি ঘন্টা গতিতে সৌর বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু এসব কিভাবে ঘটছে তার কিছুই বিজ্ঞানীরা অনুধাবন করতে পারেনি। এসব বিষয়ে গবেষণা করার জন্যই নাসা সৌরযান প্রেরণ করেছে। ২০১৮ সালের পার্কার যাত্রা শুরু করার পর এখনো পর্যন্ত এটি সূর্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে সূর্যকে ৮ম বার প্রদক্ষিণ করার সময় পার্কার সোলার প্রোব নামের ওই সৌরযানটি করোনা নামের সূর্যের বলয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েছে বলে বিজ্ঞানীরা আমেরিকান জিওগ্রাফিক্যাল ইউনিয়নের এক বৈঠকে ঘোষণা করেছেন। বিজ্ঞানীরা জানান চলতি বছরের এপ্রিলে মহাকাশযান পার্কার করোনা নামের সূর্যের বলয়ের ভেতর ঢুকে পড়ে। এখনও নভোযানটি সূর্য পৃষ্ঠ থেকে ৮০ লক্ষ মাইল দূরে রয়েছে। এটি মানবজাতির জন্য এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। দীর্ঘ ৬০ বছরের প্রচেষ্টার পর এই সাফল্য অর্জন করা গেছে।

পার্কার সোলার প্রোব মহাকাশযান সূর্যের করোনা অঞ্চলের বেশকিছু ছবি তুলে পাঠিয়েছে। এসব ছবি থেকে বোঝা যায় করোনার ভেতর সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্র অনেক তীব্র। আগামী কয়েক বছর পার্কার সোলার প্রোব সূর্যের আরো গভীরে অনুসন্ধান চালাবে।এ সময় পার্কার যে তথ্য সংগ্রহ করেছিল এতদিনে তা বিজ্ঞানীদের হাতে এসে পৌঁছেছে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী নুর রাফি এ ঘটনাকে চমকপ্রদ উত্তেজনাপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। পৃথিবীতে তৈরি কোন মহাকাশযান তো বটেই কোন বস্তুও এই প্রথম ছুঁয়ে দেখলো সূর্যকে ।
উপগ্রহ চাঁদ এর অনেক কিছুই এতদিনে জানা সম্ভব হয়ে গিয়েছে কাছের গ্রহ মঙ্গলেও এখন যাতায়াত করা যায় এবার কাছের আরেক নক্ষত্রকে আরও কাছ থেকে জানার দরজা খুলল। নাসার এই কৃতিত্বে বিজ্ঞানীরা এবার চাঁদ ও মঙ্গলের মত সূর্যের রহস্য জানার অপেক্ষাই করছেন।
বিজ্ঞানীরা জানান ২০১৮ সালে পৃথিবী থেকে সূর্যের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল নাসার সৌরযান পার্কার সোলার প্রোব । নাসার তরফ থেকে বলা হয়েছে এর আগে সূর্যের এত কাছে কোন মহাকাশযান পৌঁছাতে পারেনি। সূর্যের বলয়ের মধ্যে ঢুকে তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে পার্কার। করোনা নামের সূর্যের ঐ বলয়ে যখন পার্কার এসেছিল তখন সেখানে উত্তাপ ২ মিলিয়ন কেলভিন ছিল বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। অর্থাৎ সেখানে ১৯ লাখ ৯৯ হাজার সাতশ ছিয়াশি দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। ঐ উত্তাপের মাঝেও সেকেন্ডে ১০০ কিলোমিটার বেগে করোনার ভেতরে তথ্য সংগ্রহ করেছে পার্কার।
সূর্যের বর্হিরাবরন যাকে করোনা বলা হয় তা ভেদ করে সূর্যের ভেতরে প্রবেশ করেছে নাসার সৌর তদন্ত যান পার্কার। এই এলাকার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রবল, চৌম্বক ক্ষমতাও তীব্র। এতটাই ক্ষমতা ঐ শক্তির যে তা সৌর পদার্থকে বহিরাবরণ পেরিয়ে বের হতে দেয় না। নিরাপদে থাকে সৌরজগতের গ্রহ উপগ্রহ । নাসার বিজ্ঞানীদের ধারণা এর মধ্যে অন্তত তিনবার সূর্যের মধ্যে ঢুকেছে পার্কার। সব মিলিয়ে পার্কার দশ বার সূর্যের বলয়ে প্রবেশ করবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। ২০২৫ সাল পর্যন্ত পার্কার তার অভিযান চালিয়ে যাবে। রাফির মতে করোনা যতটা ধুলিময় মনে করা হয়েছিল তার চেয়ে বেশি ধুলিময়। তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে পার্কারের করোনায় অনুসন্ধান বিজ্ঞানীদেরকে সৌর বাযুর উৎপত্তি সম্পর্কে আরো ভালোভাবে বুঝতে ও জানতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া কিভাবে সূর্য পুরো সৌরমন্ডলকে পরিচালিত করে পার্কারের পাঠানো তথ্য থেকে সে বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।” হার্ভার্ডের স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর এস্ট্রো ফিজিক্স ইউনিভারসিটির এর অধ্যাপক দিবেন্দ্র বলেছেন, পার্কারের সৌর তদন্তের এই সাফল্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সৌর হাওয়ার উৎপত্তিকে জানা। এর আগে সৌর হাওয়া কিভাবে সূর্য থেকে পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় তা জেনে ছিল পার্কার। তবে এবার সূর্যের করোনায় প্রবেশ করে চৌম্বক ক্ষেত্র এবং প্লাজমার নমুনা সংগ্রহ করেছে। এ থেকে সৌর হাওয়ার উৎপত্তি কিভাবে কখন হচ্ছে তা জানা যাবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে জানতে এখানে ক্লিক্ করুন…