দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, শত্রু বনাম মিত্র
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে সংঘটিত সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া এই ভয়াবহ যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের মতো ভয়ংকরতম অস্ত্রের ব্যবহার বিশ্ববাসী প্রথম এবং শেষবারের মত প্রত্যক্ষ করেছিল। মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তি মধ্যকার আক্রমণ প্রতিআক্রমণ এবং ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র ব্যবহারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপুল পরিমাণ সামরিক-বেসামরিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি প্রায় সাত কোটির মত মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এই মহাসমরে প্রায় ৩০ টি দেশের ১০ কোটিরও বেশি সামরিক সদস্য অংশগ্রহণ করে। আজ আমরা জানবো মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার প্রায় ২১ বছরের মাথায় বিশ্ববাসী আর একটি মহাযুদ্ধের মুখোমুখি হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল আরও ভয়াবহ ও বিধ্বংসী। মূলতঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রতিক্রিয়াই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মিত্রশক্তি কর্তৃক জার্মানিসহ পরাজিত দেশগুলোর উপর ভার্সাই চুক্তির মত বিভিন্ন শর্ত জোরপূর্বক ভাবে আরোপ করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধানতম কারণ
দেশগুলোর পক্ষে এসব অপমানজনক ও জোড়- জবরদস্তিমূলক সন্ধির শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেসব অসম্মানজনক চুক্তি গুলিই মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধানতম কারণ হিসেবে বিবেচিত। জার্মানির নাৎসী নেতা হিটলার প্রথম থেকেই এই সব অন্যায় দাবির বিরোধিতা করেছিলেন। পরবর্তীতে তারই নেতৃত্বে জার্মানির প্রতিশোধ স্পৃহাই উন্মত্ত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করে।
তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের চেষ্টাতে জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হলেও মার্কিন সিনেট তার অনুমোদন দেয়নি। ফলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের হাতে জাতিপুঞ্জের দায়িত্ব থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মত বৃহত রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে তারা বিশ্ব উত্তেজনা প্রশমন কিংবা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অধিকাংশ উপনিবেশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। তখন জার্মানি ইতালি ও জাপানের কোন উপনিবেশ ছিল না। তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য এই দেশগুলি উপনিবেশ দখলের চেষ্টা শুরু করলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আর এই উত্তেজনার সৃষ্টিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনেকাংশে ত্বরান্বিত করে।
অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটেন-ফ্রান্সের মধ্যকার মতবিরোধকে অনেক বিশ্লেষক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন। এছাড়াও ইটালির ফ্যাসিবাদ ও জাপানের সমরবাদ নীতিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনেকাংশেই প্রভাবিত করে। এই সব দেশের শাসকগোষ্ঠী প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের নেশায় মেতে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় জাপান চীনের মাঞ্চুরিয়া, নানকিং, পিকিং সহ বহু শহর দখল করে নেয়। ইটালী ১৯৩৮ সালে আবিসিনিয়া দখল করে। জার্মানিও নতুন করে সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে রাশিয়াও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো দখলের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের পথ খুঁজছিল। পরাশক্তি দেশ গুলোর সাম্রাজ্যবাদী ও দখলদারিত্ব মনোভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ।
নাৎসী নেতা হিটলার
সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে মনোযোগী জার্মানী ও ইটালিকে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স উল্টো তাদের প্রতি তোষননীতি গ্রহণ করে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতি নাৎসী নেতা হিটলার এর নেতৃত্বে জার্মানিকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। বেপরোয়া জার্মানী রাইন ভূখন্ড, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া প্রভৃতি দেশগুলো আক্রমণ করে দখলে নিতে থাকে। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা মঞ্চ তৈরি করে। সাংগঠনিক ত্রুটি, নেতৃত্বের দুর্বলতা সহ বিভিন্ন কারণে বিশ্বশান্তি রক্ষা কিংবা সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার বন্ধ করার ক্ষেত্রে জাতিপুঞ্জ কার্যকর কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করতে পারেনি। এর ফলশ্রুতিতে জার্মানি,ইতালি ও জাপান আক্রমনাত্মক ও দখলদারিত্ব মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করে। যা বিশ্বকে আর একটি ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়।
বিভিন্ন চুক্তি মানা না মানাঃ
১৯৩৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইতালির মধ্যস্থতায় জার্মানির মিউনিখ শহরে ব্রিটেন ফ্রান্স জার্মানি ও ইতালির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা মিউনিখ চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুসারে চেকোস্লোভাকিয়ার সুদাতেন অঞ্চল জার্মানিকে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তার বিনিমযয়ে হিটলার চেকোস্লোভাকিয়ার বাকি অংশে আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মিউনিখ চুক্তি মাত্র সাত মাস পর ১৯৩৯ সালের ১৫ ই মার্চ হিটলার সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণের মাধ্যমে দখল করে নেয়। রুশ জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি কিংবা পোলেন্ডের ডানজিক বন্দরের দাবী নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেকটি পটভূমি তৈরি করেছিল।
আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুঃ
আসন্ন পোলেন্ড আক্রমণের সম্ভাবনায় ব্রিটেন, ফ্রান্স, পোল্যান্ডের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মাধ্যমে পরস্পরকে সরাসরি সামরিক সহায়তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এসময় জার্মানির প্রতি তোষননীতি ত্যাগ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এবং এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। বিশ্বের পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো বিপরীত দু’টি সামরিক জোটে বিভক্ত হয়ে এই যুদ্ধে যোগদান করে। মিত্রশক্তি নামক সামরিক জোটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন বৃটেন-ফ্রান্স ও কানাডা মত বিভিন্ন পরাশক্তিধর দেশগুলো অংশগ্রহণ করে্। অন্যদিকে জার্মানি জাপান ইতালি রোমানিয়ার মত দেশগুলো অক্ষশক্তি গঠন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে জার্মানি ইউরোপ এর অধিকাংশ এলাকা নিজেদের দখলে নেয়। অন্যদিকে জার্মানির মিত্র দেশ জাপান প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত মার্কিন ও ইউরোপীয় উপনিবেশ সমূহ আক্রমণ করে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে বেশিরভাগ অঞ্চল জয় করতে সক্ষম হয়। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবার আক্রমণ করে। এই হামলার প্রেক্ষিতে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই মহাযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহন অক্ষশক্তির এই জয়রথ থামিয়ে পরাজয়কে তরান্বিত্ব করে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে হিটলারের ভুল রণকৌশলের কারণে জার্মানি ১৯৪৩ সালে ষ্টালিনগ্রাফ যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানঃ
পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালের ৬ জুন ব্রিটেন কানাডা ও মার্কিন যৌথ বাহিনীর আক্রমণের মধ্য দিয়ে জার্মানির দখলকৃত ফ্রান্সকে পুনরায় স্বাধীন করা হয়। ১৯৪৫ সালের ৮ মে জার্মানি চূড়ান্তভাবে মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হয়। অন্যদিকে পার্ল হারবার আক্রমণ এর প্রতিশোধ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। এই পারমানবিক বোমা নিক্ষেপের ফলে দুটি এলাকা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে প্রায় চার লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। পারমানবিক বোমা নিক্ষেপের পর ১৯৪৫ সালের ১৪ই আগস্ট ধ্বংসপ্রাপ্ত জাপান মিত্রশক্তির কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবঃ
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ছিল অত্যন্ত বিস্তৃত ও সুদুরপ্রসারী। এই যুদ্ধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া বিশ্ব পরাশক্তির মর্যাদা লাভ করে। তখন বৃটেন, ফ্রান্স, ইটালি প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশগুলোর স্থান হয় দ্বিতীয় সারিতে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ গঠন করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। যা পরবর্তীতে কিউবার মিসাইল সংকট কোরিয়া সংকট কিংবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে খুঁজতে থাকে এটম বোমা বা পারমাণবিক বোমা তৈরীর কৌশল। আমেরিকানরা তখনো খুব শংকিত ছিল এই ভেবে যে জার্মানরা হয়তো যেকোনো মূহুর্তে পারমানবিক বোমা আবিষ্কার করে ফেলতে পারে। পরবর্তীতে আমেরিকানরাই প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি করে পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসকেই বদলে দেয়।
মানব ইতিহাসের সবচাইতে শক্তিশালী মারণাস্ত্র পারমানবিক বোমা কিভাবে আবিষ্কার হল তা জানতে এখানে ক্লিক্ করুন…
ইতিহাস বিষয়ে আরো জানতে এখানে ক্লিক্ করুন…