তাজমহল। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য!
মুঘল আমলে নির্মিত পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়কর এক স্থাপনা তাজমহল ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় অবস্থিত। তাজমহলের মত এমন নিদর্শন পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি খুজে পাওয়া যাবেনা। সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের স্মৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা জানাতে তাজমহল তৈরি করেছিলেন। সম্রাট শাহজাহানের সেই অনন্য কীর্তি তাজমহল আজও বিশ্ববাসীর কাছে এক অপার বিস্ময়ের নাম।
আজ আমরা জানবো পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল সম্পর্কে।
তাজমহল তৈরীর নেপথ্যেঃ
তাজমহলের স্বপ্নদ্রষ্টা মুঘল সম্রাট শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ শাহজাহান। শাহজাহান নামটি এসেছে মূলত ফারসি ভাষা থেকে, যার অর্থ পৃথিবীর রাজা। তিনি ছিলেন বাবর, হুমায়ুন, আকবর এবং জাহাঙ্গীরের পরে পঞ্চম মুঘল সম্রাট। ৫ জানুয়ারি ১৫৯২ সালে জন্ম নেওয়া এই মুঘল সম্রাট ১৬৬৬ সালের ২২ জানুয়ারি পরলোকগমন করেন। তিনি ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত উপমহাদেশ শাসন করতে শুরু করেন। আর তাজমহলের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৩২ সালে। এটি তৈরি করতে ২২ হাজার শ্রমিকের ২২ বছর সময় লেগেছিল। কথিত আছে স্ত্রী মমতাজ মহলের সমাধির কাজ শাহজাহান শুরু করলেও তার ছেলে আওরঙ্গজেব তাকে আগ্রার দুর্গে বন্দী করে রাখায় সেই কাজ আর তিনি শেষ পর্যন্ত করতে পারেননি। ১৬৬৬ সালে মৃত্যুর পর শাহজাহানকেও স্ত্রী মমতাজ মহলের সঙ্গে একই সমাধিতে সমাহিত করা হয়।

নির্মান কৌশলঃ
তাজমহল নির্মানের মূল নকশা তৈরি করেন ওস্তাদ আহমেদ লাহরি। সে সময় বেশিরভাগ মোঘল দালানই তৈরি হতো লাল বালু ও পাথর দিয়ে কিন্তু তাজমহল নির্মাণে শাহজাহান প্রথম শ্বেত পাথর ব্যবহার করেন। শ্বেত পাথরের সৌধ হিসেবে বিশ্বব্যাপী তাজমহলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাজমহল নির্মানের জায়গাটি ছিল মহারাজের জয়সিংহের সম্পত্তি। সম্রাট শাহজাহান এই জমিটি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মধ্য আগ্রার একটি প্রকাণ্ড রাজপ্রাসাদের বিনিময়ে এই জমিটির অধিগ্রহণ করেন। যমুনা নদীর তীরবর্তী তাজমহলের জমিটি ছিল খুবই নিচু। জায়গাটি এই বিশেষ সমাধি নির্মাণের উপযুক্ত করতে প্রচুর মাটি ফেলা হয়। সেই নিচু জমিতে যমুনা নদীর তীরের উচ্চতা থেকে প্রায় ১৬০ ফিট উঁচু করা হয়। তাজমহল নির্মানের জন্য ২২ হাজার মানুষ নিযুক্ত করা হয়েছিল, যারা ছিলেন সাধারণ শ্রমিক, পাথর কাটার শ্রমিক, চিত্রশিল্পী, সূচিকর্ম শিল্পী ও ক্যালিগ্রাফার। এছাড়া তাজমহলের বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী বহনের জন্য ১০০০ হাতী ব্যবহার করা হয়েছিল। তাজমহলের শ্বেত পাথর আনা হয়েছিল রাজস্থানের মাকরানা থেকে। এছাড়া পাঞ্জাব থেকে আসে পান্না, চীন থেকে স্ফটিক, তিব্বত, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে আসে নানা ধরনের নীলকান্তমণি। শ্বেত পাথরের গায়ে বসানোর জন্য মোট ২৮ ধরনের দুষ্প্রাপ্য দামি পাথর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আনা হয়। তাজমহলের এই অসাধারণ নির্মাণ সম্পন্ন করতে ভারতীয় বিশেষজ্ঞ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের স্থাপত্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসা হয়েছিল। এছাড়া তাজমহলের ভাস্করা আসেন বুখারা থেকে, হস্তাক্ষর শিল্পীরা আসেন সিরিয়া এবং পারস্য থেকে রত্ন শিল্পীরা আসেন উত্তর ভারত থেকে এবং মনিকারেরা আসেন বেলুচিস্তান থেকে। তাজমহলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকলেও এই সৌধ নির্মানে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপত্যের ছোঁয়া দেখা যায়। যেমন চারটি মিনার ও গম্বুজ মুসলমানদের মসজিদের মত এবং তাদের মাথার ত্রিশুলটি হিন্দুদের শিব মন্দির এর অনুকরণে নির্মিত।
দিনের বিভিন্ন সময়ে আলোর সাথে তাজমহলও বিভিন্ন রং ধারণ করে সকালে গোলাপী বর্ণের দুপুরে হালকা হলুদ, বিকালে দুধের মত সাদা এবং রাতে চাঁদের আলোতে সোনালী বর্ণ ধারণ করে পৃথিবীর এই আশ্চর্য স্থাপনা।
তাজমহল অত্যন্ত শক্ত ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অনেকগুলো পাতকুয়া খুঁড়ে ভীত তৈরি করা হয়েছিল। সেগুলোর উপর এক বিশাল মঞ্চ তৈরি করে তার ওপর মূল সৌধ নির্মান কাজ সম্পন্ন হয় বর্তমানে আধুনিক স্থাপত্য নির্মাণেও এই কৌশল ব্যবহার করা হয়। আর সে কারণে বড় ধরনের ভুমিকম্পেও তাজমহল সহজে ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। ভুমিকম্পে তাজমহলের মিনারগুলো যাতে মূল সমাধীর উপর ভেঙ্গে না পড়ে সেই জন্য মিনার গুলোকে বাহিরের দিকে সামান্য কাত করে তৈরী করা হয়েছে। তাজমহলের মূল আকৃতি অষ্টকনী। এতে কোন লোহার কাঠামো ব্যবহার করা হয়নি। সম্পূর্ণ পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে নির্মিত হয়েছে এই সৌধ। তাজমহলের সবচেয়ে বিস্ময়কর অংশ হলো এর মাথার উপরকার গম্বুজের কারুকাজ। এই গম্বুজ নির্মাণেও কোন লোহার কাঠামো ব্যবহার হয়নি। ছোট ছোট পাথরের টুকরো জোড়া দিয়ে বিশাল এই গম্বুজ কে নির্মান করা হয়। তাজমহলের মূল সৌধের চারধারে প্রায় ১৩০ ফুট উঁচু চারটি মিনার রয়েছে মিনারগুলোর তিনভাগে বিভক্ত প্রতিটি ভাগের শেষের দিকে গোল বারান্দা রয়েছে। টানা ১৭ বছর নির্মাণযজ্ঞ চলার পর ১৬৪৮ সালে এই স্মৃতিসৌধের প্রাথমিক নির্মাণকাজ শেষ হয়। নির্মাণকাজ শেষ হলেও এর সৌন্দর্য বর্ধন চলতে থাকে। আশপাশের কাজু বাগান এবং তিন দিকের তিনটি প্রবেশদ্বারসহ পুরোপুরি শেষ হতে আরো পাঁচ বছর সময় লাগে।
ভ্রান্ত ধারণাঃ
তাজমহল সম্পর্কে একটি বহুল প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা হলো তাজমহল নির্মাণ শেষ হওয়ার পর সম্রাট শাহজাহান শ্রমিকদের হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দেন, যাতে কেউ পুনরায় তাজমহল তৈরি করতে না পারে কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটি গল্প। আর একটি ভ্রান্ত ধারনা হলো, সম্রাট শাহাজাহান তাজমহলের বিপরীত পার্শ্বে কালো মার্বেল পাথর দিয়ে দ্বিতীয় আর একটি তাজমহল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এই গল্পটিরও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
তাজমহল হল পারস্য মধ্য এশিয়া ও ইসলামী স্থাপত্যের সমন্বিত এক সেরা নিদর্শন। তাজমহলের ভিতরে ও বাহিরে চমৎকার ক্যালিগ্রাফি আছে। মমতাজ মহলের সমাধির পাশে তার পরিচিতি ও প্রশংসামূলক ক্যালিগ্রাফি দেখা যায়। সমাধীক্ষেত্রের দেওয়ালে রয়েছে আল্লাহর ৯৯টি নামের ক্যালিগ্রাফি। তবে তাজমহলের আসল সৌন্দর্য হল এর প্রবেশদ্বারের বিশাল ক্যালিগ্রাফি। এসব ক্যালিগ্রাফিতে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে অঙ্কিত হয়েছে। আব্দুল হক নামের এক শিল্পী এসব ক্যালিগ্রাফির শ্রষ্ঠা। সম্রাট শাহজাহান তার কাজে খুশি হয়ে তার নামকরণ করেন আমানত খান। তাজমহলের উচ্চতা ২৪০ ফুট।১০:৪৯ যা দিল্লিতে অবস্থিত কুতুব মিনারের সমান।
হুমকীর মুখে তাজমহলঃ
বর্তমানে তাজমহল বাগান, গেস্ট হাউজ ও মসজিদ দিয়ে ঘেরা ১৭ হেক্টর জায়গা নিয়ে গঠিত। যে যমুনা নদী তাজমহলের অবস্থানকে মহিমান্বিত করেছিল সেই যমুনা আজ মৃতপ্রায়। তাজমহলের পাশ দিয়ে বয়ে চলা বর্তমান যমুনা ভারতের অন্যতম দূষিত এক নদী। যমুনা তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারানোতে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে নদীটি। এর ফলে তাজমহলের ভীতেরও বেশ ক্ষতি হচ্ছে। যমুনা তীরবর্তী বিভিন্ন তেলের কারখানার জন্য এ অঞ্চলের বাতাস অত্যন্ত দূষিত। বায়ু দূষণের কারণে তাজমহলের প্রকৃত রং দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুঃ
নির্মাণের পর থেকে আজ পর্যন্ত তাজমহল দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তাজমহলের দক্ষিণ পাশের ছোট শহর তাজগঞ্জ বা মমতাজবাদ গড়ে তোলা হয়েছিল এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য। সে সময়ে এখানে ছিল বেশ কিছু সরাইখানা তাজমহল নির্মাণ করতে আসা শ্রমিক ও কারিগরেরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে এ বাজার বড় করতে থাকে। এদের অনেকেই আবার তাজমহল নির্মাণ শেষে এখানে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে।
তাজমহল ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২০ থেকে ৩০ লক্ষ পর্যটক তাজমহলে ঘুরতে আসে। ভারতের বাইরে থেকে প্রায় ২ লক্ষ পর্যটক শুধু তাজমহল দেখার উদ্দেশ্যেই ভারতে আসে। সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে। বায়ু দূষণকারী যানবাহনে চড়ে তাজমহলের কাছে যাওয়ার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই পর্যটকদের গাড়ি রাখার স্থান থেকে পায়ে হেঁটে অথবা বৈদ্যুতিক বাসে করে তাজমহলে যেতে হয়।
প্রবেশ মূল্যঃ
বর্তমানে তাজমহল দর্শনে ভারতীয়দের জন্য নির্ধারিত প্রবেশ মূল্য মাত্র ৫০ রুপি, সার্কভুক্ত দেশের পর্যটকদের জন্য প্রবেশ মূল্য ৫৪০ রুপী, আর বিশ্বের অন্যান্য দেশের পর্যটকদের জন্য প্রবেশ মূল্য ১১০০ রুপী। মূল সমাধীর মধ্যে প্রবেশ করতে চাইলে ভারতীয় সহ সকল পর্যটকদেরকে অতিরিক্ত ২০০ রুপী মূল্যের টিকেট নিতে হয়। ২০১৪ সাল থেকে পর্যটকদের সুবিধার্থে তাজমহল পরিদর্শনের জন্য অনলাইন টিকেট এর ব্যবস্থা করেছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া।
বিশ্ব ঐতিহ্য বিষয়ে আরো জানতে এখানে ক্লিক্ করুন…