৭০ বছর স্থায়ী হয়েছিল যে ট্রাফিক জ্যাম
অরণ্যের মধ্যে ভৌতিক ট্রাফিক জ্যামের হীরক জয়ন্তী
মনে করুন, যদি কোনো একদিন এমন হয়, আপনি বাস-গাড়ির দীর্ঘ লাইন পড়ে গেছেন! আর সেই লাইনও সাত কিলোমিটারের কম নয়। সবাই ইঞ্জিন বন্ধ করে অপেক্ষা করছে কখন কাটবে এই বন্দীদশা অর্থাৎ ট্রাফিক জ্যাম । কিন্তু সেই অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না।
এভাবেই কেটে গেল একদিন, দু’দিন, এক সপ্তাহ, একমাস, এভাবে বছরের পর বছর। যেখানকার জ্যাম সেখানেই আছে। এর মধ্যেই আটকা পড়া একটি প্রাইভেট কারের মেয়ের সঙ্গে প্রেম হলো এক বাসযাত্রী ছেলের। সেই প্রেমও চলল বছর দুয়েক ধরে। ওই জ্যামের আশেপাশে ঘুরে ঘুরেই তারা প্রেম করে। স্বপ্ন দেখে, একদিন এই জ্যাম কেটে যাবে আর তারা সাজাবে তাদের সুখের সংসার।
কিন্তু দিনের পর দিন যায় কিন্তু ট্রাফিক-জ্যাম আর কাটে না। শেষে সবার সিদ্ধান্তে সেখানেই তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিল। মেয়ের গাড়িকে সাজানো হলো বাসর ঘর। বছর ঘুরতেই তাদের কোল আলো করে এলো ফুটফুটে দেবশিশু। যুগের পর যুগ পার হয়ে গেলেও যেখানকার ট্রাফিক জ্যাম সেখানেই থেকে গেল।
দেখতে দেখতে একবছর দুবছর করে ৭০ টা বছর পেরিয়ে যায়। শিশুরা তখন কিশোর থেকে তরুন হয়ে মধ্যবয়সে পৌছে গেছে এবং সেই প্রেমিক যুগলের বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণও হয়েছে। কিন্তু সেই ট্র্যাফিক জ্যাম তখনও সেখানেই থেকে গেছে। ঠিক একই জায়গায় তাদের ছেলের বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু ট্রাফিক জ্যাম কাটার অপেক্ষা তখনও কাটে না। সমস্ত লোক ট্রাফিক জ্যাম কোনোদিনই কাটবে না এই আশা করে সেই স্থান ত্যাগ করেন। সেই জনবসতি আস্তে আস্তে বিশাল অরণ্যে পরিনত হয়।
উপরের গল্পটি রূপকথার মতো হলেও ট্রাফিক জ্যামের ঘটনাটি একেবারেই বাস্তব সত্য ঘটনা। এ ভৌতিক ট্রাফিক জ্যামটি ওয়াক ইন ডেথ বা কোন হরর সিনামার ছবি নয়, এটি বিশ্বের সব চেয়ে বড় গাড়ীর সমাধি, যাকে বলা হয় “দ্যা সেটিলন কার গ্রেবিয়ার্ড” (Chaliton Car Graybeard) । সেটিলন শহরের কাছে ছোট এক জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে বেলজিয়ামের দক্ষিণে একটি ছোট গ্রাম হল পরিত্যাক্ত কিছু সুন্দর ও বিলাসী গাড়ির সমাধি।
পঁচাত্তর বছরের পুরোনো এই ট্রাফিক-জ্যামটি লেগেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। ১৯৪৫ সালে বেলজিয়ামের দক্ষিণাঞ্চলের দখল নিয়েছিল মার্কিন সেনা বাহিনী। তারা সেইপথ আটকে দিয়েছিল। সেই পথে সারি সারি গাড়ি দাড়িয়ে পড়ে প্রায় সাত কিলোমিটার ব্যাপী ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি করেছিল। পর পর এত গাড়ি দাড়িয়ে পড়ায় মাঝের গাড়িগুলি না এগোতে পারছিল, না পিছোতে পারছিল। এর মধ্যেই জার্মান সেনার মুহুর্মুহ আক্রমন আসতে শুরু করে। প্রাণ বাচাতে সবাই গাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকে।
সেইসময়ে তাদের ছেড়ে যাওয়া গাড়ির দীর্ঘলাইনের ট্রাফিক জ্যামটি এখনও লেগে আছে। আর সেই ট্রাফিক জ্যামটি বর্তমান বেলজিয়ামের দক্ষিণাঞ্চলের স্থানে। আস্তে আস্তে সেই স্থানটি কালের পরিক্রমায় বনাঞ্চলে পরিনত হয়ে গেছে। যারা সেখানে গাড়ি ছেড়ে গিয়েছিল তাদের চতুর্থ বা পঞ্চম প্রজন্ম আজও মাঝেমধ্যে সেই স্থানে গাড়িগুলোকে দেখতে আসেন আর তাদের পূর্বপূরুদের স্মরণ করেন। এটি বর্তমানে বেলজিয়ামের একটি দর্শনীয় স্থানও বটে। এই বিখ্যাত প্রাচীন ট্রাফিক জ্যামকে বলা হয় “গাড়ির কবরস্থান”। এসব দেখলে লোকে ভাবতে বাধ্য হয় – “কত বিচিত্র এ পৃথিবী”।
আবার শোনা যায়,
এই গাড়ীগুলো একসময় আমেরিকান সেনাদের অধীনে ছিল। যখন তারা এই অঞ্চলে একটি ঘাঁটি তৈরি করেছিল। যুদ্ধের মাঝেও মার্কিন সেনারা কিভাবে গাড়িগুলোর মালিক হলো সে রহস্য আজও অজানা।
যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো সব সেনাদের আমেরিকা ফিরে যেতে বলা হয়। কিন্তু এ সুন্দর ও দামী গাড়ী গুলোকে আমেরিকাতে নিয়ে যাওয়া অনেক বেশি ধকল ও ব্যায় বহুল। তখন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশে এই বিলাসবহুল গাড়ি গুলো বেলজিয়ামে রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ধারণা করা হয় সেখানে প্রায় পাঁচ শতাধিক গাড়ি ছিল। সেগুলো একটি পাহাড়ের উপর নিয়ে গেল তারা এরং লোক চক্ষুর আড়াল করে গাড়ী গুলোকে এক এক করে পার্ক করলো পরিপাটি করে। এরপরেই যুগ যুগ ধরে মূল্যবান গাড়িগুলোকে সেখানে পড়েছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কালের পরিক্রমায় অধিকাংশ গাড়ী গুলো চুরি হয়ে যায় কিংবা স্থানীয় কিছু অসাধু লোক অধিকাংশ গাড়ীগুলো সরিয়ে ফেলে। শেষ মুহুর্তে ২০১০ সালে পরিবেশগত বিষয়ে চিন্তা করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই গাড়ীর সমাধিকে বেলজিয়াম সরকার পরিষ্কার করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেন।
আরো ইতিহাস জানতে এখানে ক্লিক্ করুন…