কিডনির রোগ ও সমাধান এবং কিডনি প্রতিস্থাপন, ডায়ালাইসিস ও মূত্রনালি সুস্থ রাখার উপায়
কিডনির রোগ ও সমাধান
আমাদের মানবদেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ রেচন অঙ্গ হলো আমাদের বৃক্ক। যা আমদের দেহের বর্জ্য পদার্থ গুলো নিষ্কাশন করতে সাহায্য করে। একজন স্বাভাবিক মানুষ প্রতিদিন প্রায় ১৫০০ মিলিলিটার মূত্র ত্যাগ করতে সক্ষম হয়। এর সব কাজ গুলো বৃক্ক করে থাকে।
বৃক্কে পাথর নানারকম রোগের কারণে বৃক্ক বা কিডনির স্বাভাবিক কাজ গুলো করে না। কিডনির প্রদাহ, প্রস্রাবে সমস্যা, কিডনিতে পাথর হওয়া এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকে।
কিডনির রোগের লক্ষণ গুলো হলোঃ
১। শরীর ফুলে যাওয়া,
২। প্রস্রাবে অতিরিক্ত প্রোটিন যাওয়া,
৩। রক্ত মিশ্রিত প্রস্রাব হওয়া,
৪। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করা,
৪। ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া বা ক্ষেত্রবিশেষে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া।
মানুষের কিডনিতে ছোট আকারের পাথর জাতীয় পদার্থের সৃষ্টিই বৃক্ক বা কিডনির পাথর হিসেবে পরিচিত। কিডনিতে পাথর সবারই হতে পারে, তবে দেখা গেছে, মেয়েদের থেকে পুরুষদের পাথর হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
কিডনির রোগের কারণ গুলো হলোঃ
১। অতিরিক্ত শারীরিক ওজন,
২। কিডনির সংক্রমণ,
৩। কম পানি পান করা ইত্যাদি ।
প্রাথমিকভাবে বৃক্কে পাথর হলে বেশি সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় যখন পাথর মানুষের প্রস্রাব নালিতে চলে আসে এবং প্রস্রাবে বাধা প্রদান করে। তখন বৃক্ক এর অবস্থা ও আকার নির্ণয় করে চিকিৎসা করা হয়।
বৃক্কে পাথর হলে যে গুলো উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়ঃ
১। কোমরের পিছনে ব্যথা হবে।
২। অনেকের প্রস্রাবের সাথে রক্ত বের হয়।
৩। অনেক সময় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে।
বৃক্কের পাথরের চিকিৎসা নির্ভর করে পাথরের আকার এবং অবস্থানের উপর। সাধারণত অধিক পানি গ্ৰহণ এবং ঔষধ সেবনে পাথর অপসারণ করা যায়। আধুনিক পদ্ধতিতে ইউরেটারোস্কোপিক কিংবা আল্ট্রাসনিক লিথট্রিপসি অথবা বৃক্কে অস্ত্রোপচার করে পাথর অপসারণ করা যায়।
কেন কিডনি বিকল হয়?
বৃক্ক বিকল, ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপন নেফ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনিতে পাথর ইত্যাদি কারণে কিডনি ধীরে ধীরে বিকল হয়ে যায়। আকস্মিক কিডনি অকেজো বা বিকল হওয়ার কারণগুলো হলো কিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মারাত্মক ডায়রিয়া, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি। কিডনি বিকল হলে মূত্রের পরিমাণ কমে যাবে। রক্তে ক্সিয়োটিনিন বৃদ্ধি পাবে। তখন রক্তের বর্জ্য দ্রব্যাদি অপসারণের জন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর রোগীকে ডায়ালাইসিস করা হয়।
ডায়ালাইসিস ( Dialysis )
বৃক্ক সম্পূর্ণ অকেজো বা বিকল হওয়ার পর বৈজ্ঞানিক উপায়ে রক্ত পরিশোধিত করার নাম ডায়ালাইসিস। সাধারণত ( ডায়ালাইসিস মেশিনের ) সাহায্যে রক্ত পরিশোধিত করা হয়। এ মেশিনের ডায়ালাইসিস টিউবটির এক প্রান্ত রোগীর হাতের কব্জির ধমনির সাথে এবং অন্য প্রান্ত ঐ হাতের কব্জির শিরার সাথে সংযোগ দেওয়া হয়। ধমনি থেকে রক্ত ডায়ালাইসিস টিউবের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করানো হয়। এর প্রাচীর আংশিক বৈষম্যভেদ্য হওয়ার ইউরিয়া, ইউরিক এসিড এবং অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ বাইরে বেরিয়ে আসে। পরিশোধিত রক্ত রোগীর দেহের শিরার মধ্য দিয়ে ভিতর পুনরায় প্রবেশ করে। এখানে উল্লেখ্য, ডায়ালাইসিস টিউবটি এমন একটি তরলের মধ্যে ডুবানো থাকে, যার গঠন রক্তের প্লাজমার অনুরুপ হয়। এভাবে ডায়ালইসিস মেশিনের সাহায্যে নাইট্রোজেনঘটিত ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থ ( ইউরিয়া এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ ) বাইরে নিষ্কাশিত হয়। তবে এটি একটি ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।
কিডনি প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়াঃ
প্রতিস্থাপন যখন কোনো ব্যক্তির কিডনি বিকল বা অকেজো হয়ে পড়ে তখন কোনো সুস্থ ব্যক্তির কিডনি তার দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়, তাকে কিডনি সংযোজন বলে। কিডনি সংযোজন ২ ভাবে করা যায় :
১। কোনো নিকট আত্মীয়ের কিডনি অথবা কোনো মৃত ব্যক্তির কিডনি রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। নিকট আত্মীয় বলতে বাবা, মা, ভাই-বোন, মামা, খালাকে বোঝায়।
২। মৃত ব্যক্তি বলতে ( ব্রেন ডেড ) মানুষকে বোঝায়, যাঁর আর কখনোই জ্ঞান ফিরবে না কিন্তু তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কৃত্রিমভাবে জীবিত রাখা হয়েছে। মরণোত্তর চক্ষুদানের মতো মরণোত্তর বৃক্ক দানের মাধ্যমে একজন কিডনি বিকল রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভবপর হতে পারে। মরণোত্তর সুস্থ কিডনি দানে মানবজাতির উপকার করা যায়।
পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ কিডনি অকেজো রোগী কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে সুস্থ জীবন যাপন করছে আমাদের দেশেও কিডনি সংযোজন কার্যক্রম সাফল্যের সাথে করা হচ্ছে। তবে আমাদের দেশে আইনগত জটিলতার কারণে রক্তের সম্পর্ক না থাকলে রোগীকে কিডনি দান করা যায় না, এজন্য অনেক সময় রোগীর জরুরি কিডনি প্রতিস্থাপন থেকে বঞ্চিত হন। একটি কিডনি কার্যক্ষম থাকলেই সেটি দিয়ে জীবনধারণ করা সম্ভব, তাই একটি সুস্থ কিডনি প্রতিস্থাপন করে রোগের চিকিৎসা করা যায়। তবে দেখতে হবে যে টিস্যু ম্যাচ করে কি না। পিতা-মাতা, ভাই-বোন এবং নিকট আত্মীয়ের কিডনির টিস্যু ম্যাচ হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপনে, দৈনিক অপর্যাপ্ত পানি পান করলে এবং অন্যান্য নানা কারণে মূত্রনালির রোগ দেখা দেয়। মূত্রনালির সংক্রমণ হলে মূত্রনালি জ্বালাপোড়াসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়। ডাক্তারের সত্বর পরামর্শ এবং চিকিৎসা গ্ৰহণে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা সম্ভব।
যে নিয়ম গুলো মেনে চলতে হবেঃ
অনেকে ডায়ারিয়া বা বমি হওয়া ছাড়াই গরমে ঘেমে গেল, ক্লান্ত অবস্থায় কিংবা তেমন কোনো কারণ ছাড়াই খাবার স্যালাইন পান করে থাকেন। এটি একেবারেই ঠিক নয়, বিশেষ করে বয়স্ক মানুষের বেলায় ডায়ারিয়া বা বমি হলেও তাঁদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক সঠিক পরিমাণে স্যালাইন দিতে হবে। সাধারণ ক্লান্তি বা ঘামের ক্ষেত্রে লেবুর রস এবং সামান্য লবণমিশ্রিত শরবতই যথেষ্ট। ডায়াবেটিস না থাকলে এতে কিছুটা চিনিও যোগ করা যেতে পারে। তাই চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী চলায় শ্রেয়।
যেভাবে মূত্রনালি সুস্থ রাখা যায়ঃ
১। শিশুদের টনসিল এবং খোসপাঁচড়া থেকে সাবধান হওয়া প্রয়োজন, কারণ সেখান থেকে কিডনির অসুখ হতে পারে।
২। ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।
৩। ডায়ারিয়া ও রক্তক্ষরণ ইত্যাদির দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে।
৪। ধূমপান ত্যাগ করা এবং ব্যথা নিরাময়ের ঔষধ যথাসম্ভব পরিহার করা প্রয়োজন।
৫। পরিমাণমতো পানি পান করতে হবে।
৬। সবচেয়ে বড় কথা, নিয়ম মেনে জীবন যাপন করতে হবে।