History

বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রত্নস্থল কান্তজি মন্দির

Pathokia 

বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রত্নস্থল- বিশ্বের একমাত্র অরনামেন্টাল মন্দির কান্তজি মন্দিরের ইতিহাসঃ

কৃষ্ণর নানা কাহিনী, সমকালীন সমাজ জীবনের বিভিন্ন ছবি এবং জমিদার অভিযুক্তদের বিনোদনের চিত্রগুলো মাটির ফলকে অলংকৃত করে শৈল্পিক সৌন্দর্য দিনাজপুরের নিভৃত পল্লীতে ঢেপা নদীর পাড়ে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলা স্থাপত্যের বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্বীকৃত কান্তজীর মন্দির।

ইতিহাসঃ কান্তজি মন্দির

কান্তজি মন্দির
নয়টি চূড়া বিশিষ্ট প্রাচীন কান্তজি মন্দির এবং পুনঃ নির্মিত বর্তমান কান্তজি মন্দির।

বাংলাদেশের বিখ্যাত কারুকার্য  খচিত  মন্দির কান্তজি মন্দির এর ইতিহাস নিয়ে আজ আলোচনা করবো।  কান্তজি মন্দির বা কান্তনগর মন্দির ইটের তৈরি আঠারো শতকের মন্দির। বাংলার স্থাপত্য সমূহের মধ্যে বিখ্যাত এই মন্দিরের বিশিষ্ট তার অন্যতম কারণ হচ্ছে পোড়ামাটির অলঙ্করণে মন্দিরের দেয়ালের গায়ে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কান্তজি মন্দিরটি সনাতন ধর্মের কান্ত বা কৃষ্ণের মন্দির হিসেবে পরিচিত যা লৌকিক রাধাকৃষ্ণের ধর্মীয় প্রথা হিসেবে বাংলায় প্রচলিত। বাংলাদেশ দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার উত্তরে এবং দিনাজপুর তেতুলিয়া সড়কের প্রায় দুই কিলোমিটার পশ্চিমে ঢেপা নদীর ওপর পাড়ে এক শান্ত নিবৃত গ্রাম কান্তনগরে এ মন্দিরটি অবস্থিত। এই নবরত্ন বা নয় শিখর যুক্ত হিন্দু মন্দিরের চুড়াঁ থেকে আদি নয়টি শিখর  ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন রয়েছে এই মন্দিরে।

কান্তজি মন্দির । টেরাকোটা
কান্তজি মন্দিরের দেয়ালে অলংকৃত টেরাকোটা

মন্দিরের নির্মাণ তারিখ নিয়ে সন্দেহ ছিল তা অপসারিত হয় মন্দিরের পূর্বকোণের ভিত্তি দেয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি কালানুক্রম জ্ঞাপক এক শিলালিপি থেকে। সূত্র অনুযায়ী দিনাজপুরের মহারাজ প্রানোনাথ ১৭২২ সালে নবরত্নের এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন এবং এবং শেষ করেন ১৭৫২ সালে। তার স্ত্রী রুকমণির আদেশে পিতার ইচ্ছে পূরণ করার জন্য মহারাজের দত্তকপুত্র মহারাজ রামনাথ 1752 সালে মন্দিরটি নির্মাণ সম্পন্ন করেন। বিশ শতকের শুরুতে মহারাজা গিরিজানাথ বাহাদুর ভূমিকম্প ধ্বংস  হয়ে যাওয়া ছাড়াই মন্দিরটির ব্যাপক সংস্কার করেছিলেন। এই জমকালো পিরামিড আকৃতির মন্দিরটি তিনটি ধাপে ওপরে উঠে গিয়েছে এবং তিন ধাপের কোনগুলি ওপরে মোট নয়টি অলংকৃত শিখর বা রত্ন ছিল যা দেখে মনে হত যেন একটি উচুঁ ভিত্তির ওপর প্রকাণ্ড অলংকৃত রথ দণ্ডায়মান। মন্দিরের চারদিকে খোলা খিলান পথ রয়েছে যাতে যে কোন দিক থেকে পূজারীরা ভেতরের পবিত্র স্থানে রাখা দেবমূর্তি দেখতে পায়। ১৫.৮৫ মিটার আয়তনের বর্গাকৃতির মন্দিরটির চারদিকে রয়েছে পূজারীদের বসার স্থান যা ঢেউটিন দ্বারা আচ্ছাদিত। বর্গাকার প্রধান প্রকোষ্ঠটিকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ ইমারত নির্মাণ হয়েছে। ১.০০৫ মিটার পাথরের উপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ১৫ মিটার বেশি। ধারণা করা হয় গঙ্গারামপুর এর নিকট বান নগরীর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ থেকে নির্মাণ উপকরণ এনে এটি তৈরি করা হয়েছিল।  বাইরের দিকে উঁচু করে তৈরি তিনটি চতুষ্কোনাকার প্রকোষ্ঠ এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এই ধরনের নকশা কেন্দ্রীয় প্রকোষ্ঠটিকে শক্তিশালী করেছে। তাই উপরের বিরাট চূড়াটিকে এই প্রকোষ্ঠের পক্ষে ধারণ কর সম্ভব হয়েছে। পূজারীদের চালার বাইরে প্রধানমন্দিরের  প্রায় ১০০ গজ দূরে আগাছায় ছাওয়া একটি একচূঁড়া বিশিষ্ট ছোট ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির রয়েছে। প্রচলিত ধারণা মতে মহারাজ প্রানোনাথ ১৭০৪ সালে এই মন্দির তৈরি করে এখানে কৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সাময়িকভাবে বৃন্দাবন থেকে আনা হয়েছিল। নবরত্ন মন্দির তৈরি সমাপ্ত হলে এই মুর্তিটি এখানে স্থানান্তর করা হয়।  এটি এখন একটি পরিত্যক্ত দেবালয়। ভিত্তি থেকে শুরু করে মন্দিরের চূড়া পর্যন্ত ভেতরে ও বাইরের দেয়ালের প্রতিটি অংশে তিনটি পৌরাণিক কাহিনীর অনুসরণে মনুষ্যমূর্তি ও প্রাকৃতিক বিষয়াবলী বিস্ময়কর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মহাভারত ও রামায়ণের বিস্তারিত কাহিনী এবং অসংখ্য পাত্র-পাত্রীর বিন্যাস ঘটেছে এখানে। কৃষ্ণের নানা কাহিনী সমকালীন সমাজ জীবনের বিভিন্ন ছবি এবং জমিদার অভিজাত্যের বিনোদনের চিত্র প্রতিভাত হয়েছে।

কান্তজি মন্দির । নবরত্ন মন্দির
নবরত্ন মন্দির

পোড়ামাটির এই শিল্পগুলির বিশ্ময়কর প্রাচুর্য মূর্তির গড়ন কোমল ভাব ও সৌন্দর্য এত যত্নের সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে বাংলার যে কোন মুরালচিত্রের চেয়ে অনেক উৎকৃষ্ট।  কেউ যদি মন্দির দেয়ালের অলংকরণের দৃশ্য যে কোন দিক থেকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখেন এবং বিষয়বস্তুকে সমন্বিত করেন তবে এর বিষয়বৈচিত্র্য দেখে অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হবেন। আপাতদৃষ্টিতে মন্দিরের দেওয়ালে ব্যাপকভাবে পোড়ামাটির চিত্র অলংকরনকারী লোকশিল্পীদের অনেকে এসেছিলেন কৃষ্ণনগর থেকে। তারা তাদের পরিচিত পরিবেশের প্রভাব শিল্পকর্মে প্রতিফলিত করেছেন। প্যানেলে সূক্ষভাবে চিত্রায়িত দেবতাগণের আদল কখনো কখনো বিস্ময়কর ভাবে তাদের সমাজের পরিচিত সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলে গিয়েছিল।  কান্তজীর মন্দিরের চমৎকার পোড়ামাটির অলঙ্করণে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হলো যে এতে কামোদ দৃশ্যাবলী চিত্রে অঙ্কন করা হয়নি যেমনটি দেখা যায় উনির্ষ্যার এবং দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরসমূহে। কান্তজীর মন্দিরের দেয়ালের উপর পোড়ামাটির এই বিশাল অলঙ্করণ সেই সময়ের জীবণ ও প্রাণশক্তিরই প্রকাশ ছিল এবং হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের পলিময় মাটিতে লালিত শক্তির ভেতর থেকেই এই শিল্প গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের মতো এবং ব্যাপক উর্বর পলিময় ভূমিতে পাথরের অভাব হেতু দেশীয় ধারায় পোড়ামাটির শিল্পের বিকাশ যৌক্তিক কারণেই ঘটেছিল।

কান্তজি মন্দির
কান্তজি মন্দির (উপরের অংশ)

প্রত্নতত্ত্ব মানুষের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে অধ্যয়ন করে সে সময়কার বস্তুগত ও অবস্তুগত সহস্কৃতি সম্পর্কে আমাদেরকে সুনির্দিষ্ট ধারণা দেয়। প্রত্নতত্ত্ব প্রাচীনকালের মানুষের স্থাপত্য, জীবন-যাপনের কৌশল, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রভৃতি জানা এবং আমাদের সভ্যতা কত পুরাতন সে সম্পর্কে ধারনা দেয়। তাই আসুন আমরা সকলেই এই মহামূল্যবান সম্পদগুলি রক্ষা করি।

বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রত্নস্থলের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুণ…

Recommended Posts

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মসজিদ
World Heritage Bangladesh

ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মসজিদ

মুসলমানদের তথা মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র উপসনালয় মসজিদ। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ হলেও এখানকার ইসলামের ইতিহাস তেমন পুরাতন নয়। বাংলাদেশে কিছু প্রাচীন মসজিদ ছাড়া মোঘল আমলের পূর্বের প্রায় সকল প্রাচীন মসজিদ ই ধ্বংস হয়ে গেছে। আজ আমরা তেমনই কিছু ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মসজিদ সম্পর্কে জানবো। সিংগাইর মসজিদঃ মধ্যযুগীয় এই সিংগাইর মসজিদটি ষাটগম্বুজ মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে অবসিহত। […]

Pathokia 

গেঁটেবাত থেকে মুক্তির উপায়

গেঁটেবাত থেকে মুক্তির উপায় শতাধিক প্রকারের বাতরোগের মধ্যে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা গেঁটেবাত অন্যতম। সাধারণত বয়স্করা এ রোগে আক্রান্ত হয়।কম বয়সী ছেলেমেয়েদের বেলায় গিঁটে ব্যথা বা যন্ত্রনা হওয়া রিউমেটিক ফিভার বা বাতজ্বর ( Rheumatic Fever ) জাতীয় অন্য রোগের লক্ষণ হতে পারে। মানব শরীরে রক্তের সঙ্গে ইউরিক অ্যাসিড (Uric Acid) নামে এক ধরনের উপাদান থাকে, যার […]

Pathokia 
Artimis:NASA’s Mega Moon Rocket
Science and Technology

আর্টেমিস : আবারও চাঁদের বুকে মানুষ

আর্টেমিস :আবারও চাঁদের বুকে মানুষ Artimis:NASA’s Mega Moon Rocket দীর্ঘ পাঁচ দশক পর আবারও চাঁদের বুকে মানুষ পাঠানোর অভিযানে নাসা। তিন ধাপের মিশনে মনুষ্যবিহীন প্রথম রকেট টি ২৯ আগস্ট যাওয়ার কথা ছিল। আর শেষ ধাপে পাঠানোর কথা ছিল মানুষ। এর মাধ্যমে শুরু হতে যাচ্ছিল বহুল প্রতীক্ষিত আর্টেমিস যুগের। ফ্লোরিডার কেপ কেনেডি স্পেস সেন্টারে (Kennedy Space […]

Pathokia 

1 Comment

  1. […] বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রত্নস্থলের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুণ… […]

Comments are closed.