মুসলিম বিজ্ঞানী আল-বিরুনী কে ছিলেন?

আল-বিরুনী কে ছিলেন

মুসলিম বিজ্ঞানী আল-বিরুনী কে ছিলেন?

আল বিরুনী মুসলিম জাহানের গৌরব। বিখ্যাত মনীষী পুরো নাম আবু আল রায়হান মাহমুদ ইবনে আহমদ আল বিরুনী । ৪ সেপ্টেম্বর ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে পুরাতন অক্সাস নদীর তীরে যা বর্তমান আমুদরিয়া নদী নামে অধিক পরিচিত। খোরাসানের একটি জায়গা রয়েছে বর্তমানে এটি উজবেকিস্থান নামে পরিচিত সেখানে জন্মগ্রহণ করেন আল-বিরুনী । দশম শতকের শেষ এবং একাদশ শতকের শুরুর দিকেই বিশ্বের যে সকল মনিষী সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন তাদের মধ্যে আল-বিরুনী অন্যতম । জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়ন, জীবতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, দর্শনশাস্ত্র, ইতিহাস কিংবা ধর্মতত্ত্বে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর । আজকে আমরা মুসলিম জাহানের গৌরব বিখ্যাত এই মনীষী সম্পর্কে জানাবো ।

তার ছেলেবেলা নিয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। হয়তো ইতিহাস নিয়ে কাজ করা মহান ব্যক্তিত্বের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রাখার আগ্রহ বোধ করেননি তিনি। ধারণা করা হয় তিনি আল ইরাক বংশের রাজপতি আবু মুনসুর বিন আলী ইবনে ইরাকের তত্ত্বাবধানে বাল্যকালে শিক্ষা লাভ করেন ।পরবর্তীতে আল-বিরুনী তার এক লেখায় জানান তিনি তাঁর নিজের বাবাকে ভালো করে চিনতে না এমনকি তার বংশ নিয়েও তার কোন ধারণা ছিল না ।তাঁর ছেলেবেলা থেকেই যুদ্ধ দেখে এসেছেন তিনি । ২২ বছর ছিলেন রাজার অনুগ্রহে কিন্তু রাজার অনুগ্রহ বেশিদিন কপালে জোটেনি। তার লালনপালনকারী সেই রাজার রাজ্যে আক্রমণ করেন সুলতান মাহমুদ। দখল করে নেন সেই রাজ্য। আল বিরুনীর দীর্ঘদিন তার বুদ্ধি দিয়ে এইভাবে সুলতান মাহমুদের রাজ্যে হামলা করা ঠেকিয়ে ছিলেন কিন্তু তাঁর তার একার বুদ্ধি হয়তো সুলতান মাহমুদের বীরত্বের নিকট হেরে গিয়েছিল। আপন ভূমির এমন পরাজয় মেনে না নিতে পেরে রাজ্য থেকে বের হয়ে দুচোখ যেদিকে যায় সে দিকে চলে যায় আল-বিরুনী।

তিনি তখন বুখারায় সামানিদ রাজতন্ত্রের অধীনে কিছুদিন অবস্থান করেন। সেটি ছিল ইরানের পূর্বাঞ্চল এবং আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অংশ নিয়ে। তিনি তখন রাজা কাবুস ইবনে ভস্নবীরের সু-নজরে আসেন । রাজা তাকে সম্মানিত করে রাজদরবারে আশ্রয় দেন। সেখানেই কাস্পিয়ান সাগরের নিকট গুরগাওন শহরে দেখা হয় বিশ্বের মহান মনীষীর দার্শনিক ও বিজ্ঞানী ইবনে সিনার সাথে। যিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন। আজও চিকিৎসাশাস্ত্রের কথা এলে তার নামই প্রথম দিকেই থাকবে। কিন্তু সুলতান মাহমুদ তার প্রভাব বাড়াতে এবার হাত বাড়ান এই  রাজতন্ত্রের দিকে । দখল করে নেন পুরো এলাকা । ইবনে সিনা এবং আল বিরুনী কে তার দরবারে আসন গ্রহণ করতে বলা হয়। পালিয়ে যান ইবনেসিনা ।অন্যদিকে নিজের ভূমির মায়া ছেড়ে হয়তো যেতে পারেনি আল-বিরুনী থেকে যেতে হয় সুলতান মাহমুদের সাথে।  রাজা কাবুসের সাথে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে আল বিরুনীর। তাই নিজের লেখা আল আসার  আল বাকীয়া ও আন আল কুরুন আল খালিয়া শিরোনামের দুইটি বই রাজা কাবুসকে উৎসর্গ করেন তিনি।

গজনীতে অবস্থান করার সময় আল-বিরুনী পরিচিত হন বিখ্যাত পন্ডিত আবুল খায়েরের সাথে। আবুল খায়ের এর নিকট তিনি শিক্ষা নেন গ্রীক ভাষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়ে। অনেকেই বলে থাকেন তখনই তিনি ভারতে ভ্রমণ করেছিলেন। একাদশ শতকের শুরুর দিকের কথা এটি। সুলতান মাহমুদের পর তার দুই ছেলের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয় এবং যুদ্ধে জয়ী হন মাসুদ। ক্ষমতা দখল করেন ১০৩১ খ্রিস্টাব্দে। আল-বিরুনী এই মাসুদের সুনজরে ছিলেন। এমনকি মাসুদকে তার পক্ষে রাখতে তিনি ফলিত জ্যোতিষ্ক নিয়ে তাঁর লেখা একটি বইয়ের নাম দেন কানুন আল মাসুদ। তার এই গ্রন্থের ১১টি খন্ড ছিল । প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড আলোচনা করেছেন বিজ্ঞানের আকর্ষণীয় শাখা জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে। তৃতীয় খন্ড ত্রিকোণমিতি ষষ্ঠ খন্ড সূর্যের গতি নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। কথিত আছে এই বইটি তার নামে উৎসর্গ করায় রাজা মাসুদ খুশি হয়ে আল বিরুনী কে দ্রব্যসামগ্রীর উপহার দেন। মহানুভবতার প্রতীক আল বিরুনী সেগুলো রাজকোষে জমা দিয়ে দেন।

মৃত্যুর ১৩ বছর পূর্বে নিজের কাজের একটি তালিকা করেন তিনি। তালিকা অনুযায়ী তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ১১৪ টি । গণিত, জ্যামিতি ও এ বিশ্বের গঠন সম্পর্কে ৫০৩ অধ্যায়ের বৃহৎ কিতাবুল স্তাসকিম তার রচিত। ইফরাদুল ফালফীল আমরীল আজলাল  গ্রন্থে  জ্যোতির্বিজ্ঞানের ছায়াপথ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন তিনি । পৃথিবীর প্রাচীন কালের  ইতিহাস নিয়ে তাঁর অনবদ্য রচনা আল আসারুল বাকীয়া আল আল কুবানীল কালীয়া। যুক্তিবিদ্যায়ও তিনি বই রচনা করেছেন । তবে যে বইটির জন্য আমাদের  উপমহাদেশের মানুষদের কাছে তিনি একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব হয়ে আছে তাহলো ভারত নিয়ে তার লেখা বই ইন্ডিয়া।

বর্বর জাতির ইতিহাসের খীর সমুদ্র ও দধির সমুদ্র ছাড়া আর কি আছে । ভারত বর্ষ ভ্রমণ শেষ করে আল-বিরুনী তখন তার নিজ দেশে ফিরেছেন । তার এক বন্ধুর সাথে ভারতবর্ষ ও এর  ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করছিলেন।  তখন বন্ধুর মুখ থেকে এমন মন্তব্য শুনার পর তার মনে ভাবোদয় হয়। মানুষের এই ভ্রান্ত ধারণা তিনি চাইলে ভাঙতে পারতেন কারণ তিনি ভারতবর্ষে শুধু বেড়াতেই আসেন এখানে এসেছেন জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে এখানকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানতে। এবার তিনি তাই সিদ্ধান্ত নিলেন ভারত বর্ষ নিয়ে বই লিখবেন । তিনি এমন এক বই লিখলেন যা ভারতবাসীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে আছে। কি ছিল এই বইয়ের বিষয়বস্তু । ভারতের ভাস্কর্য দর্শন এবং ইতিহাসের রস আস্বাদন করে সেগুলোর বিস্তর প্রশংসা ছিল তার বইয়ে । ভারতকে জ্ঞনের পূণ্য ভূমি হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। ভারতের পণ্ডিতদের জ্ঞানকে প্রশংসায় ভাসছেন আল-বিরুনী । তবে শুধু প্রশংসা করে থেমে থাকেননি এখানকার প্রতিটি কাজকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ।

ভারতের জাদুকররা রসায়নকে বাজে ভাবে প্রয়োগ করেছে বলে তিনি খুবই হতাশা প্রকাশ করেন।  তিনি বৈজ্ঞানিক প্রণালীর প্রাচীন ভারতের অনুলিপি নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ মূলক আলোচনা করেছেন। ভারতের ঐতিহ্যে অতিরঞ্জন তিনি পছন্দ করেননি। এখানকার সংস্কৃত ভাষায় সবকিছুর বারতি  ব্যাখ্যা তার কাছে অহেতুক কাজ বলে মনে হয়েছে তবে একজন মুসলমান হয়ে তিনি যেভাবে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের তাদের ইতিহাসের এবং সংস্কৃতির প্রশংসা করেছেন তা ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা । উল্টোদিকে তার স্বদেশীদের হিংসাত্মক মনোভাব এর গঠনমূলক সমালোচনা করেন আল-বিরুনী। যদিও তারা তার নিজ ধর্মের অনুসারী অর্থাৎ তাঁর লেখায় স্বাধীনচেতা একটি ভাবছিল। যা আজকাল আমরা মুক্ত চিন্তা হিসেবে আখ্যায়িত করি। কিন্তু তিনি তাঁর লেখায় হ্রাস টেনেছিলেন।

আরবি, ফার্সি, গ্রীক, শিরিও, হিব্রু,সংস্কৃতির ছাড়াও  আরো  অনেক ভাষার দখল ছিল আল বিরুনীর। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস প্রথম এ ধারণা দেন বলে আমরা জানি কিন্তু তার জন্মের ৪২৫ বছর পূর্বেই এমন কথা বলে গেছেন আল বিরুনী। বৃত্ততে পৃথিবী ঘুরে। তার আরেকটি অনবদ্য কাজ হচ্ছে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের জটিল সম্পর্ক আমাদের সামনে দাঁড় করানো। তিনি প্রথম আমাদেরকে ধারণা দেন যে ফুলের পাপড়ির সংখ্যা হয় ৩ ৪ ৫ ৬ ও ১৮ সেটা কখনোই ৭/৯ হবেনা। চিকিৎসা বিদ্যাতেও তাঁর অবদান ছিল। তিনি বহু রোগের চিকিৎসা জানতেন। ১০৫২ সালে বর্তমান আফগানিস্তানের গজনীতে মহান এ মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনী না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নেন একজন মহাবিজ্ঞানী । তার কাজগুলো আজ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে কিন্তু তাকে তেমনভাবে স্মরণ করা হয় না । অন্যান্য বিজ্ঞানীরা যেমন মর্যাদা পান এবং খ্যাতি এখনো বিদ্যমান, আল-বিরুনী তেমন ভাবে গুরুত্ব পান না কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি অন্যদের ছাড়িয়ে গেছেন তাঁর সমকালীনদের চেয়ে কিংবা কখনো তার পরের প্রজন্মের জ্ঞানীদের চেয়েও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


hacklink satın alporno izleizmir escorteryaman escortGaziantep escortonwin girişTavşanlı escortGiresun escortankara escortkayseri escorteryaman escortsweet bonanza oynaPendik Escortistanbul escortanadolu yakası escorthalkalı escortmaltepe escortKurtkoy Escortyeşilköy escortYeşilköy otele gelen escortflorya eve gelen escortFlorya Kolombiya Escortgenç escort yeşilköyOtele Gelen Escort Yeşilköybeylikdüzü escortbuca escortfethiye escortısparta escortEscort BayanTürkiye Escort, Escort Bayanmarmaris escortBahçeşehir escortizmir escortBursa EscortSlot bonusu veren sitelerdeneme bonusu veren sitelerSütunlar güncellendi.
Twitter Takipçi Satın AlKartal evden eve nakliyatimplantantalya haberkeçiören evden eve nakliyatDeselerMasal OkuMasallar OkuNasrettin Hoca FıkralarıMasallarMasallarİstanbul mevlid lokmasıankara evden eve nakliyatİstanbul izmir evden eve nakliyatmamak evden eve nakliyatEtimesgut evden eve nakliyattuzla evden eve nakliyateskişehir uydu tamirankara parca esya tasımaSütunlar güncellendi.